ওরা এক সময় এদেশের বনে-বাদাড়েই ঘুরে বেড়াতো বটে তবে এখন তুমি হাজারটি খুঁজলেও ওদের আর দেখা পাবে না। আমাদের হারিয়ে যাওয়া বা বিলুপ্ত প্রাণীর তালিকাতেই ওদের খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে আশার কথা আমাদরে দেশ থেকে হারিয়ে গেলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অন্যান্য কিছু দেশে ওদের বংশধরেরা এখনো বেঁচে আছে। মূলত প্রাকৃতিক পরিবেশের হঠাৎ কোন পরিবর্তন, অবাধে গাছ কাটা, অতিমাত্রায় শিকার, খাদ্যাভাব, দীর্ঘস্থায়ী প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবসহ নানা কারণে একটি দেশ থেকে বন্যপ্রাণী প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে।
তবে কোন বন্যপ্রাণী প্রজাতি বিলুপ্তির ক্ষেত্রে মানুষের সৃষ্ট কারণই বেশি। আবার অনকে সময় কোন কোন প্রাণী প্রজাতি পৃথিবী থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যায়। কোনো প্রাণী প্রজাতির বিলুপ্ত বলতে সমগ্র পৃথিবী থেকে একটি জিনপুলের নিশ্চিহৃ হওয়াকে বোঝায়। চলো আজ জেনে নেই বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রাণী সর্ম্পকে:
ডোরাকাটা হায়েনা (THE STRIPED HYENA)
এর স্থানীয় নাম নেকড়ে বাঘ বা হায়েনা। বৈজ্ঞানিক নাম Hyaena hyaena। পুরুষ হায়েনা লম্বায় ৫ ফুট, উচ্চতায় ৩ ফুট এবং ওজনে ৮৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। স্ত্রী হায়েনার ওজন পুরুষের তুলনায় সামান্য কম। হায়েনা দেখতে অনেকটা কুকুরের মত। বন-জঙ্গলের চেয়ে হায়েনাকে খোলা প্রান্তরেই বেশি দেখা যায়। ছোট পাহাড়, ঝোপঝাড়, আখক্ষেতের ভিতর পালিয়ে থাকে হায়েনা। কিংবা শজারুর গর্তকেও নিজের মত করে বাসা বানিয়ে নেয়। এরা একা কিংবা দলবেঁধে শিকার করে। ছাগল, ভেড়া, ছোট কুকুর ছানাসহ মানবশিশু ঘর থেকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে হায়েনার। রাতের বেলা হায়েনা তারস্বরে চিৎকার করে। হায়েনাকে বাচ্চা অবস্থা থেকে পুষলে পোষও মানে। প্রাণীবিজ্ঞানীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এক সময় বাংলাদেশের দিনাজপুর, রংপুর, সমগ্র রাজশাহী বিভাগ এবং খুলনা বিভাগের কিছু কিছু অংশে হায়েনার বিচরণ ছিলো। কিন্তু এখন আর নেই। বর্তমানে হায়েনা আছে ভারত, নেপাল, উত্তর আফ্রিকা, আরব, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, রাশিয়া ও তুর্কিমেস্তানে।
নেকড়ে (THE WOLF)
নেকড়ের বৈজ্ঞানিক নাম Canis lupus। এদের উচ্চতা আড়াই ফুটের কাছাকাছি। লম্বায় তিন থেকে সাড়ে তিনফুট হয়। ওজন ১৮ থেকে ২৭ কেজি। নেকড়েও দেখতে প্রায় কুকুরের মতো। এদের চোখ হলুদাভ। নেকড়েরা জঙ্গলের খোলা প্রান্তরে ঘুরে বেরায়। শিকারের জন্য সময়ের বাছ বিচার করেনা। যখন তখন মানুষের সামনে থেকেই তুলে নিয়ে যায় ছাগল, ভেড়া। নেকড়ের প্রধান শিকার গবাদিপশু। তবে দলব্দ্ধ অবস্থায় মানুষকে আক্রমেনর বদনামও আছে ওদের। প্রাণীবিজ্ঞানীদের মতে বাংলাদেশের নোয়াখালি জেলায়, পার্বত্য চট্রগ্রাম অঞ্চলে, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলেও নেকড়েদের বিচরণ ছিলো। এখন আর বাংলাদেশে নেকড়ে না দেখা গেলেও বর্তমানে নেকড়ে আছে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, কাশ্মির, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, তিব্বত, উত্তর আরব ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে।
মালয়ী সুর-ভালুক (THE MALAYAN SUN BEAR)
সুর ভালুকের বৈজ্ঞানিক নাম Helorctos malayanus। এরা লম্বায় ৩ থেকে সাড়ে ৪ ফুট এবং ওজনে ২৭ থেকে ৬৫ কেজি পর্যন্ত হয়। মাটি থেকে দেহের উচ্চতা ২ ফুট। ভালুকদের মধ্যে সুর ভালুক সবচেয়ে ছোট। গায়ের পশম কুচকুচে কালো। কান ছোট আর নাক গোলাকার। এদের জিহ্বা অনেক লম্বা। সাধারণত গহীন পাহাড়ি বনে বাস করে। প্রাণীবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সুর ভালুক ৯ থেকে ১২ হাজার উঁচুতে বরফের কাছেও পাওয়া যায়। শীতকালে নিচে নেমে আসে। এরা একই সঙ্গে মাংশাসী ও তৃণভোজী। খাবার হিসেবে ফলমূল, ঘাস, লতাপাতা, মধু ছাড়াও ছাগল, ভেড়া, পাখি এমনকি উইপোকাও ধরে খায়। সুর ভালুকরা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও গারো পাহাড়ে বিচরণ করতো। এমনকি সিলেটেও ছিলো বলে ধারণা করেন প্রাণীবিজ্ঞানীরা। সুর ভালুকের বিলুপ্তির অন্যতম একটি কারণ হলো ভ্রান্তবিশ্বাস। ধারনা করা হত যে এর পিত্তথলি, করোটি দিয়ে তৈরি ওষুধ খেলে সুস্বাস্থ্য ও যৌবন লাভ করা যায়। আর এটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় সুর ভালুকের জন্য। এছাড়া বন ধ্বংস ও ফসল রক্ষার জন্য তাদের মেরে ফেলা বিলুপ্তির কারণ।
গন্ডার (THE RHINOCEROS)
সারা পৃথিবীতে ৫ প্রজাতির গন্ডারের মধ্যে বাংলাদেশেই তিন প্রজাতির গন্ডার পাওয়া যেতো। সেগুলো হচ্ছে বড় একশৃঙ্গী গন্ডার (Rhinoceros unicornis), ছোট একশৃঙ্গী গন্ডার (Rhinoceros sondaicus) ও এশিয়ান দ্বিশৃঙ্গী গন্ডার (Dicerorhinus sumatrensis)। গন্ডারের উচ্চতা সাদারণত ৬ ফুট বা তার একটু বেশি। তবে এদের গড় উচ্চতা ৫ ফুট। দেহের ওজন ১৮০০ থেকে ২২০০ কেজি।
গন্ডারের শরীর বেশ হৃষ্টপুষ্ট, চামড়া মোটা, কর্কশ ও লোমবিহিন। কাঁধের সামনে পেছনে ও উরুর সামনে চামড়া ভাজ হয়ে নেমে বর্মের মত দেখায়। নাকের উপর একটি বা দুটি শিং-এর মতো থাকে। পাড়াড়ি এলাকা, জলাভুমি ও গিরিখাতে এদের বসবাস করতে দেখা যায়। গন্ডার সাধারণত একা চলে। মল ত্যাগ করে একই জায়গায়। মল জমে জায়গাটি উঁচু হয়ে গেলে নিজের নাক দিয়ে ঢুস মেরে তা গুঁড়িয়ে আবার সমান করে দেয়। হাতির জাত শত্রু গন্ডার। কোনো হাতিকে একা পেলে কিংবা হাতির দলে কোনো পুরুষ হাতি না থাকলে তা অন্য হাতিদের জন্য বিপদজ্জনক হয়ে দাড়ায়। মারামারিতে যে দুজনেই জেতে তা নয়। অনেক সময় দুজনেই মরে পড়ে থাকে। মরা হাতির পাজরে গন্ডারের শিং ঢুকে আছে এমনও দেখা গেছে। এরা প্রতি তিন বছর পর পর একটি বা দুটি বাচ্চা প্রসব করে। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, সিলেট, গারো পাহাড়, রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও সুন্দরবনে দেখা মিলত এসব গন্ডারদের। গন্ডারের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নানা কুসংস্কার ও চিকিৎসা সেবায় কাজে দেয় বলে গন্ডার শিকারের মাত্রা বেড়ে যাওয়াকে এ দেশ থেকে এই প্রাণীটির বিলুপ্তির অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন প্রাণীবিজ্ঞানীরা।
বনগরু (THE INDIAN BISON/ GAUR)
এদের বৈজ্ঞানিক নাম Bos frontalis। গড় উচ্চতা সাড়ে ৫ ফুটের বেশি। বয়স্ক একটি ষাড়ের ওজন ৯০০ কেজি হয়ে থাকে। এরা বিশাল মাথা, সুঠাম দেহের অথিকারী। চোখের রং বাদামি। তবে মাঝেমাঝে নীলচে দেখায়। পাহাড়ি বনে বাস করে এরা। ঋতু ভেদে নিচু জমিতেও চলে আসে। দেখতে এদের ভয়ংকর মনে হলেও আসলে কিন্তু মোটেও তা নয়। এদের বাচ্চাকে ধরে পোষ মানানোর অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্ত তিন বছরের বেশি বাঁচানো যায় না। পুরোনা নথিপত্র অনুযায়ী, চট্টগ্রামে প্রচুর বনগরু ছিলো। সিলেট, টেকনাফ, ময়মনসিংহ, কুমিলা, ছাগলনাইয়াতেও একসময় বনগরুর দেখা মিলত। তবে তাদের বেশিরভাগই পাহাড়ে ফিরে যেতে ব্যর্থ হত। কেননা অধিকাংশ সময় মানুষ তাদের ধরে জবাই করে খেয়ে ফেলত। বর্তমানে ভারত, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, চীন, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় বন গরু দেখতে পাওয়া যায়।
বান্টেং (THE BANTENG)
বান্টেং এর বৈজ্ঞানিক নাম Bos javanicus। এদের আঞ্চলিক নাম বান্টিং বা বনগরু। সুঠাম দেহের অধিকারী বান্টেং এর উচ্চতা সাড়ে ৫ ফুট। এরা হালকা পাতা ঝরা বন ও চির সবুজ বনে ঢাকা ঘাস ও বাঁশের ফাঁকা জায়গায় বাস করে। এরাও বেশ শান্ত প্রাণী। বান্টেং এর দৃষ্টি, শ্রবণ ও ঘ্রাণশক্তি অনেক প্রখর।
বাংলাদেশের শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামেই বান্টেং পাওয়া যেত।
বুনো মোষ (THE WILD BUFFALO)
বুনো মোষের বৈজ্ঞানিক নাম Bubalus bubalis। কোনো অঞ্চলে এদেরকে বন মহিষ বা বয়ার নামেও ডাকা হয়। এদের উচ্চতা সাড়ে ৫ ফুটের মত হয়। শরীরের ওজন ৯০০ কেজি। পোষা মোষের মতই দেখতে বুনো মোষ। এদের দুই ধরনের শিং দেখা যায়। ধনুকের মত বাকানো ও অর্ধচন্দ্রাকার। বুনো মোষের বসবাসের প্রিয় জায়গা জলাশয়ের পাশে লম্বা ঘাস ও নলখাগড়ায় পূর্ণ বন। এরা দিনের বেশিরভাগ সময় কাটায় জলে শুয়ে ও কাদায় গড়াগড়ি দিয়ে। গরু গোত্রের মধ্যে বুনো মোষই সবচেয়ে সাহসী ও হিংস্র প্রাণী। বাঘকেও অনেক সময় ভয় পায় না এরা। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় সবখানেই বুনো মোষের বিচরণ ছিলো। সুন্দরবন, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল ও বাগেরহাটের অনেক স্থানেো বুনো মোষের দেখা মিলত। সুন্দরবন সংলগ্ন কিছু স্থানে বুনো মোষের প্রাচুর্য্যের জন্য এসব অঞ্চলের কিছু স্থানের নামকরণ করা হয়েছে বয়ারগাতি, বয়ারডাঙ্গা, বয়ারশিঙ্গে ইত্যাদি। এছাড়া ময়মনসিংহ, জামালপুরেও এদের দেখা মিলত। কিন্তু দুঃখের বিষয় এরাও বিদায় নিয়েছে আমাদের বনভূিম থেকে।
কৃষ্ণসার (THE BLACKBUCK)
এদের বৈজ্ঞানিক নাম Antelope cervicapra। উচ্চতা ৩২ ইঞ্চি আর ওজন ৪০ কেজির মত। এরা অনেকটা হরিণের মতই দেখতে। পুরুষ কৃষ্ণসার দেখতে অনেক সুন্দর। সবজু ঘাসে ভরা উন্মুক্ত প্রান্তর এদের বিচরণের প্রিয় জায়গা। এদের দৌড়ও দেখার মত। কয়েক কদম চলার পরপরই একেকবার লাফ দেয়। দৌড়ে গ্রে হাউন্ডকেও হার মানায় এরা। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে দেখা যেত এদের। রাজশাহী, দিনাজপুর, খুলনা, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরেও এদের দেখা মিলত বলে মত দিয়েছেন অনেক প্রাণী বিজ্ঞানী।
নীলগাই (THE BLUEBULL)
এদের বৈজ্ঞানিক নাম Bocephalus tragocamelus। এদের উচ্চতা ৫২ থেকে ৫৬ ইঞ্চি। দেখতে অনেকটাই বিদঘুটে চেহারার ঘোড়ার মত। এদের ঘাড়ে গাঢ় লোম আছে। নীলগাই ছোট পাহাড় ও জংলা মাঠে চরতে পছন্দ করে। মহুয়া গাছের রসালো ফুল এদের দারুণ পছন্দ। পানি পান ছাড়াই দীর্ঘসময় কাটিয়ে দিতে পারে এরা। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে যেমন দিনাজপুরে এক সময় নীলগাইয়ের দেখা মিলত। বর্তমানে ভারতের কিছু কিছু প্রদেশে নীলগাইয়ের দেখা মেলে।
জলার হরিণ (THE SWAMP DEER)
এদের বৈজ্ঞানিক নাম Cervus duvauceli। অনেকে এদের বারশিঙ্গা বলে ডাকে। উচ্চতায় ৫৪ ইঞ্চি এবং ওজনে ১৭৫ কেজি থেকে ১৮০ কেজি বিশিষ্ট হয়। এরাও দেখতে সাধারণ হরিণের মতই। তবে এদের শিংয়ের আলাদা বৈশিষ্ট বিদ্যমান। জলাভুমির আশেপাশে সবুজ ঘাসে পূর্ণ জায়গা এদের বিচরণের প্রিয় স্থান। বাংলাদেশে রংপুর, দিনাজপুর, সুন্দরবন, নোয়াখালি, বাকেরগঞ্জ, সিলেট ও চট্টগ্রামে একসময় দেখা মিলত এদের।
বামন শুকর (THE PYGMY HOG)
এদের বৈজ্ঞানিক নাম Sus salvinus। স্থানীয় নাম ঠান্ডরি শূয়ার। উচ্চতা ১৮ থেকে ২০ ইঞ্চির মত। ওজন ৩ থেকে ৫ কেজি। বামন শূকরের আকার একটি বড়সড় খরগোশের মতো এবং দেখতে সাধারণ শূকরের এক মাস বয়সী বাচ্চাদের মতই। শালবন ও উলুঘাস বনে বাস করে। বাংলাদেশের সিলেটে বামন শূকরের দেখা পাওয়া যেতো বলে মনে করেন প্রাণীবিজ্ঞানীরা।