জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্মরণে বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির (বিসিএস) আয়োজনে ‘নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ’ শীর্ষক এক ডিজিটাল স্মরনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১ মে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিসিএসের ফেসবুক পেজে এই সভাটি সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।
বিসিএস সভাপতি মো. শাহিদ-উল-মুনীরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত স্মরণ সভায় আলোচক ছিলেন বিসিএসের সাবেক সভাপতি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, সাবেক সভাপতি এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ আব্দুল্লাহ এইচ কাফী, সাবেক সভাপতি এবং ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খান, সাবেক পরিচালক এবং লিডস কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল আজিজ, সেতু বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সচিব এবং জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সভাপতি ড. এ কে আব্দুল মুবিন এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে যোগ দেন বিসিএসের সাবেক মহাসচিব মুনিম হোসেন রানা।
নক্ষত্র পুরুষ ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী যিনি জেআরসি স্যার নামেই পরিচিত, তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘প্রযুক্তিখাতের ব্যবসায়ীদের জামিলুর রেজা স্যারের কাছে ঋণ রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালাসহ সব সময়ই দেখেছি, তিনি সবার আগে ইন্ডাস্ট্রিকে গুরুত্ব দিতেন। এই খাতে কাজ করতে গিয়ে যখনি কোন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি অথবা চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছিল তখন জামিলুর রেজা স্যার মাথার ওপর হাত দিয়ে আমাদেরকে উৎসাহ দিয়ে যেতেন। আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন এবং সঙ্গে যুক্ত থাকতেন’।
‘স্মৃতি হাতড়ে তিনি আরও বলেন, একসময় স্যারের বাসার দোতালাতেই আমি থাকতাম। সেখানে বসেই কমপিউটার সমিতির কমিটি গঠন করা হয়েছে। সমিতির সেই কমিটির অনেক সদস্য জেআরসি রিপোর্ট প্রস্তুতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তৎকালীন ভারতের ন্যাসকমের সাবেক সভাপতি দেওয়ান মেহতাকে বাংলাদেশে এনে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের নিয়ে সেমিনার করেছেন। এটা সম্ভব হয়েছে জেআরসি স্যারের কারণেই। তাঁর সুপারিশেই কমপিউটারেরর সফটওয়্যার আমদানীর ওপর থেকে সম্পূর্ণ শুল্ক ও ভ্যাট মওকুফ করা হয়। ট্যাক্স হলিডে থেকে শুরু করে প্রযুক্তিবান্ধব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়েছে। এখনো জেআরসি কমিটির রিপোর্ট সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই আমলনামাটা ২০৪০ সাল পর্যন্ত চলবে’।
আব্দুল্লাহ এইচ কাফী বলেন, ‘তত্ববধায়ক সরকারের শাসনের শেষ দিনেও তিনি ভি-স্যাট সেবা উন্মুক্ত করতে বিসিএসের আবেদন সই করে দেন। এটি উন্মুক্ত করার পরও একটা অপারেটরের মাধ্যমে ৬৪ কেবিপিএস ব্যান্ডউইথ সংযোগ নিতে গিয়েও বছরে যখন ৯৬ হাজার ইউএস ডলার দিতে হতো। এই বিল কমানোর পেছনেও তাঁর অবদান রয়েছে। তিনিই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এম এস কিবরিয়া সাহেব, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, টেলিকম মন্ত্রী নাসিমকে এই ইন্টারনেটের ফলে লেখা-পড়ার কাজে আসবে এবং দেশের উপকার হবে যুক্তি দিয়ে তাদেরকে দিয়ে ৯৬ হাজার ইউএস ডলার থেকে ২৫ হাজার ডলারে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন’।
মো. সবুর খান বলেন, ‘জামিলুর রেজা স্যারের অনুপ্রেরণাতেই ফলেই বিসিএস থেকে আমি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে আইসিটি মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি পাশ করাতে সক্ষম হয়েছিলাম’।
শেখ আব্দুল আজিজ বলেন, ‘১৯৯৭ সালে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি টাস্কফোর্সে কাজ শুরু করি। ১৪ সদস্য বিশিষ্ট ঐ কমিটির সদস্য ছিলাম বিধায় জেআরসির কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখতে পেরেছিলাম। ড. চৌধুরীর সঙ্গে ভারত ভ্রমণে গিয়ে আমরা তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়েছিলাম। ওই টাস্ক ফোর্সের প্রস্তাবের ভিত্তিতেই কমপিউটার ও এর যন্ত্রাংশের ওপর শুল্ক ও কর মওকুফের সিদ্ধান্ত নেয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত প্রথম সরকার’।
ড. এ কে আব্দুল মুবিন বলেন, ‘পারিবারিকভাবেই আমি জেআরসিকে চিনতাম। কর্মক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে আমার ভালো জানাশোনা ছিলো। এত নম্র এবং বিনয়ী ও উচ্চমনের মানুষের দেখা খুব কমই মিলে। জালালাবাদ এসোসিয়েশনে যোগ দেয়ার পরে উনার সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। অসীম মেধাসম্পন্ন এই মানুষটি থেকে শেখার অনেক কিছু ছিল। সবচেয়ে বড় দিক যেটা আমি বলবো, সেটা উনার দূরদর্শিতা’।
মুনিম হোসেন রানা বলেন, ‘ছাত্রজীবনে জেআরসি স্যারকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ফিজিক্সে পড়ার সময় কমপিউটার বিষয়ে আমি থিসিস করি। তখন আমার স্যারের সঙ্গে পরিচয় হয়। তারপরে কমপিউটার ব্যবসায় আসার পর স্যারের সঙ্গে প্রচুর কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। অ্যামেচার রেডিও আমার অন্যতম একটি শখ। তখন স্যাটেলাইট ব্যবহার করে আমরা বিনামূল্যে যোগাযোগ করতে পারতাম। এই খাতেই স্যারের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। পরবর্তীতে যতগুলো কমপিউটার মেলা আমি বিসিএস থেকে করেছিলাম সবগুলোতেই আমরা স্যারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পেয়েছিলাম।
‘কীর্তিমানের মৃত্যু নেই’ উল্লেখ করে বিসিএস সভাপতি মো. শাহিদ-উল-মুনীর বলেন, ‘এই দেশ এবং দেশের মানুষ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জেআরসি স্যারকে স্মরণ করবে। আমরা তার কাছে চির ঋণী। তার মৃত্যুতে আমরা ঘনিষ্ঠ স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করছি।প্রত্যাশা করছি, এ দেশের তরুণ প্রজন্ম সদাহাস্য, নিপাট ভালো মানুষ, আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক এই জাতীয় অধ্যাপকের সহজ সরল জীবন চলা, উচ্চমানের শিক্ষকতা, গবেষণা এবং নির্ভেজাল স্বদেশপ্রেম থেকে শিক্ষা নেবে’।
প্রসঙ্গত, ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন প্রযুক্তি শিল্পবান্ধব একজন মানুষ। দেশের এই ক্রান্তিকালে তার প্রয়াণ অপূরণীয় ক্ষতি। ডিজিটাল যাত্রায় সবচেয়ে বড় ক্ষতি। তবে এই বাতিঘরের আলোয় নিজেদেরকে উদ্ভাসিত করতে পারলে করোনায় প্রযুক্তি খাতের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব বলে মনে করছেন তার সমসাময়িক প্রযুক্তিযোদ্ধারা।