আমাদের বীরগাথা

0
1766

ডিসেম্বর। আমাদের বিজয়ের মাস। বাঙালির গৌরবের মাস। পরাধীনতার শেকল ভেঙে মুক্ত হওয়ার মাস। এই বিজয় ছিনিয়ে আনতে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে মুক্তিকামী বাংলার জনগনকে। শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হয়েছে নির্ভীক চিত্তে। স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে অানতে বুকের তাজা রক্তে রাঙাতে হয়েছে মাতৃভূমিকে। বিজয়ের মাসে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের গৌরবগাথার টুকরো কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলাে এ প্রজন্মের পাঠকদের জন্য-

মোঃ শাহজাহান সিদ্দিকী, বীরবিক্রম-এর জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৭ জুলাই বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার নবীনগর উপজেলার সাতমোড়া গ্রামে। তবে ম্যাট্রিক পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের সময় শিক্ষকরা নিজেদের একটি মনগড়া জন্মতারিখ ৩১ জানুয়ারি ১৯৫০ বসিয়ে দেন। বর্তমানে এটাই তার অফিসিয়াল জন্মতারিখ। তার বাবা আব্দুর রাজ্জাক সিদ্দিকী ছিলেন স্থানীয় একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ১৯৬৭ সালে এইচএসসি পাসের পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্নাসের ছাত্র অবস্থাতেই মোঃ শাহজাহান সিদ্দিকী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধে ‘অপারেশন জ্যাকপট’-এর আওতায় নৌ-কমান্ডো হিসেবে দাউদকান্দি ফেরিঘাট অপারেশনের নেতৃত্ব দেন। সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে সফলভাবে এই অপারেশনটি সম্পন্ন করার জন্য স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীরবিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে। যুদ্ধ শেষে তিনি ফিরে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনায়। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
……………………………………………………………

কুমিল্লার কংশনগরের পূর্বদিকে অবস্থিত একটা বর্ডার এলাকা। আমাদের বিদায় জানাতে ইন্ডিয়ান নেভির একজন ব্রিগেডিয়ারসহ কমান্ডার সামন্ত এবং আমাদের ২নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন হায়দার এসেছিলেন। ওখান থেকে আমাদের ট্রাকে করে গোপনে নিয়ে যাওয়া হলো শালবন ঘেরা উঁচু টিলা এলাকা বক্সনগরে। শুধু নৌকমান্ডোদের জন্য এখানে একটি ট্রানজিট ক্যাম্প খোলা হয়েছে। নাম দেয়া হয়েছে ‘নিউ ট্রানজিট ক্যাম্প’।

এই ক্যাম্পে অবস্থানকালীন এক বিকেলে ক্যাপ্টেন দাশ আমাকে ডেকে জানতে চাইলেন ‘গান শুনবেন?’ বাঙালি মাত্রই গান প্রিয়। আমি বললাম ‘শুনবো।’ তিনি টেপরেকর্ডার চালু করে দিলেন। বাংলা গান বাজছে। অনেকগুলো গান বাজার পর বললেন ‘আরো শুনবেন?’

বললাম, ‘হ্যাঁ শুনবো।’ তখন তিনি আমাকে ‘আমি তোমায় যতো শুনিয়েছিলেম গান, তার বদলে চাইনি কোনো প্রতিদান।’ এবং ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি। ওরে, তোরা সব উলুধ্বনি কর’ গান দুটি শুনিয়ে বললেন ‘দুটি গান মুখস্থ করার চেষ্টা করেন।’ আমি তখনো বুঝিনি কেন মুখস্থ করবো? এরপর বললেন, ‘সামরিক বিশেষজ্ঞদের বিবেচনায় কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি ফেরিঘাট অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে পশ্চিমাঞ্চল কমান্ড এবং ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে যোগাযোগ ঘটে এই ফেরিঘাট দিয়েই।

আবার ঢাকায় ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্যসামন্ত মুভমেন্টেও এই ঘাট ব্যবহার করা হয়। তখন এই একটি মাত্র রাস্তাই ছিল। তাই দাউদকান্দি ফেরিঘাট ধ্বংস করতে হবে। আমি বললাম ‘ইয়েস ক্যাপ্টেন।’ তিনি বললেন ‘আপনিই সেই ঘাট ধ্বংস করবেন। আপনার সঙ্গে আটজন নৌকমান্ডো থাকবে।

আপনি হবেন তাদের টিম লিডার।’ আমি তো পুরো অবাক। কারণ টিম লিডার হবেন পাকিস্তান নৌবাহিনী থেকে আসা বাঙালি সাবমেরিনাররা। আমি তো সাধারণ একজন নৌকমান্ডো। তিনি জানালেন ট্রেনিংয়ের সময়েই তারা আমাকে এই ধরনের কাজের জন্য নির্বাচন করেছেন। আমিই একমাত্র যোগ্য। তাই আমাকে টিম লিডার করে দাউদকান্দি ফেরিঘাট উড়িয়ে দেয়ার জন্য আলাদা একটা টিম করা হয়েছে।

এসব বলে তিনি বললেন, ‘গান দুটি আবার শুনেন। কিন্তু এই গান কোথাও লিখে রাখতে পারবেন না। মুখস্থ করে নেন। যখন অপারেশনে যাবেন তখন আপনাকে ছোট একটা ট্রানজিস্টার দেয়া হবে। এটা এমনভাবে নেবেন যাতে আপনার সাথী কমান্ডোরা মনে করেন এটা আপনি অবসর সময়ে জয় বাংলা (তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে জয় বাংলা বলা হতো) বা আকাশবাণী কলকাতা শোনার জন্য নিয়েছেন।

এটা ছাড়া আপনাদের সঙ্গে থাকবে লিমপেড মাইন আর কমান্ডো নাইফ।’ নির্দেশনা অনুযায়ী আমি আমার দলকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ টিম থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। আমিসহ মোট নয়জনের একটি দল। এই ফাঁকে বলে রাখি, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের লিমপেড মাইনগুলো সরবরাহ করেছিল রাশিয়া। লিমপেড মাইনের ভেতরে হেভি এক্সপ্লোসিভ থাকে।

সাধারণত ব্রিজ উড়াতে যে ধরনের এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করা হয় তারচেয়ে লিমপেড মাইনের এক্সপ্লোসিভের শক্তি ১২০ গুণ বেশি। জাহাজের গায়ে মাইন স্থাপন করার পর ওয়াটার সলিউবল ফিউজের গায়ে লাগানো প্লাস্টিকের ক্যাপটি টেনে খুলে দাঁতে কামড় দিয়ে আটকে নিয়ে আস্তে আস্তে সাঁতার কেটে নিরাপদ স্থানে ফিরে আসতে হয়। লিমপেড মাইন টার্গেটে ঠিকমতো স্থাপন করা হয়েছে কিনা তার প্রমাণ স্বরূপ এই ক্যাপটি টিম লিডারকে দেখিয়ে পানিতে ফেলে দিতে হয়। অন্যথায় কঠিন শাস্তির বিধান রয়েছে।

ফিরে আসি দাউদকান্দি অপারেশনের ঘটনায়। আমাদের কাছে থাকা স্টেনগানটি বাজারের ব্যাগে ভরে নিলাম। লিমপেড মাইনগুলো নিলাম মাথার ওপর টুকরিতে। তার ওপর শাকসবজি দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো। যাতে কেউ দেখলে মনে করে কুলিরা সবজি বেচতে হাটে যাচ্ছে। কিছু নগদ টাকাও দেয়া হলো আমার কাছে। আমরা রওনা দেয়ার পরপরই অন্ধকার নেমে এলো। ক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে চললাম।

হঠাৎ করেই আমাদের সামনে থাকা চাঁদপুর গ্রুপের কয়েকজন কমান্ডো পানিতে লাফিয়ে পড়লো। দেখে আমাদের গ্রুপ দাঁড়িয়ে গেলো। তবে আমরা কেউ পানিতে লাফিয়ে পড়লাম না। আসল ঘটনা হলো কলাগাছের একটি শুকনো পাতা ঝুলে পড়েছিল। তা দেখে অন্ধকারে ওই গ্রুপের কোনো কমান্ডোর মনে করেছে ওখানে খাকি কাপড়ে পাকিস্তান আর্মি দাঁড়িয়ে আছে।

তা দেখে তিনি অ্যামবুশে পড়ছেন ভেবে পাশের খালে লাফিয়ে পড়েন। তার দেখাদেখি অন্যরাও লাফিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ দেখি ক্যাপ্টেন হায়দার পেছন থেকে ছুটে আসছেন। তাকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কারণ তার তো এখানে আসার কথা নয়। পরে জানতে পারলাম তিনি আমাদের রওনা করার পর ক্যাম্পে ফিরে যাননি। বরং আমরা ঠিক মতো গন্তব্যে যেতে পারছি কিনা তা দেখার জন্য আমাদের পেছন পেছন আসছিলেন।

তার সঙ্গে ছিল শুধু একটা চাইনিজ লাইট মেশিনগান এবং তার দেহরক্ষী একজন মুক্তিযোদ্ধা। এভাবে তিনি বাংলাদেশের ভেতরে প্রায় ৪-৫ কিলোমিটার এসেছেন। এই ঘটনা মনে হলে আজো ক্যাপ্টেন হায়দারের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়। তিনি আসার পর খাল থেকে যোদ্ধাদের তোলা হলো। ক্যাপ্টেন হায়দার আমাদের একদিকে আর চাঁদপুর গ্রুপকে অন্যদিকে রওনা করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।

আমরা সারা রাত হেঁটে ভোরের দিকে পৌঁছলাম কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের জাফরগঞ্জের কংশনগর বাজারের পূর্ব পাশে গোমতী নদীর বাঁধের ওপর। ক্যাপ্টেন হায়দার আমাদের সঙ্গে দুজন গাইড দিয়ে দিয়েছিলেন। তারা আমাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবেন। এমনকি আমাদের জন্য কোথায় গোপন আস্তানা হবে তাও তারাই ঠিক করবেন। আমরা খেয়া পার হয়ে নদীর পশ্চিম পারে এলাম।

চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম কোনো পাকিস্তানি টহল গাড়িও নেই। এরপর সবাইকে বললাম, ‘একজন একজন করে বাজারটা পার হবে। যাতে কেউ সন্দেহ না করে।’ বাজারের ওপাশে বৈদ্যুতিক খুঁটি ছিল। বললাম ‘ওই খুঁটির পাশে আমরা সবাই মিলিত হবো।’ আমার ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন মতিউর রহমান নামের একজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দলের কমান্ডার হিসেবে আমাকে ভূষিত করা হয় ‘বীরবিক্রম’ খেতাবে এবং আমার ডেপুটি কমান্ডারকে ভূষিত করা হয় ‘বীরউত্তম’ খেতাবে। তিনি পেশায় ছিলেন একজন বেবিট্যাক্সি চালক। বাজারটা পার হয়ে আবার সবাই একত্রিত হলাম। পশ্চিম দিকে প্রায় ৩ কি.মি. পথ হাঁটার পরই দেখি ছইওয়ালা একটা নৌকা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। নৌকায় ওঠার পর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম কারণ পাকিস্তান বাহিনীর হাতে এখন আর ধরা পড়ার আশঙ্কা নেই।

ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে নৌকা এগিয়ে চললো। আমরা এসে পৌঁছলাম দাউদকান্দির বন্ধরামপুর গ্রামে। এই গ্রামের এক বাড়ির ঘাটে এসে আমাদের নৌকা ভিড়লো। সাদা রঙের লম্বা জোম্বা পরা ও মাথায় টুপি দেয়া একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক ঘাটে এসে আমাদের প্রত্যেককে বুকে টেনে সাদরে গ্রহণ করলেন। তাকে দেখেই মনে শ্রদ্ধার ভাব উদয় হলো।

তিনি হলেন পীরে কামেল আল্লামা শাহ কামাল। তার অনেক ভক্ত মুরিদান আছেন। এই একটা ঘটনা থেকেই তার দেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। পীর সাহেব আমাদের থাকার ব্যবস্থা করলেন বাড়ির অন্দর মহলে। যেখানে তার স্ত্রী-পরিজন থাকেন। তার বাড়ির বাইরেও অনেক ঘর ছিল। যেখানে তার মুরিদরা আসেন। জিকির আজগার করেন।

মুরিদরা সবাই জানতেন পীর সাহেবের স্ত্রী বাপের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। আসলে তার স্ত্রীকে তিনি বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন যাতে বাড়ির ভেতরে আমাদের নিরাপদে রাখা যায়। ক্যাপ্টেন হায়দার পীর সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই বাড়িতে আমাদের গোপনে ও নিরাপদে থাকার এই ব্যবস্থাটি আগেই করে রেখেছিলেন।

এই ফাঁকে বলে রাখি, ‘অপারেশন জ্যাকপট’-এর মূল পরিকল্পনাকারীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই অপারেশনটি পরিচালিত হবে ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্টের দিবাগত গভীর রাতে। কারণ সেদিন পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। কমান্ডো হামলার মাধ্যমে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসটি বিবর্ণ করে দিতে হবে। কমান্ডো হামলার সময় নির্ধারণের জন্য চন্দ্র-তিথির অবস্থান এবং আবহাওয়া সংক্রান্ত সকল ধরনের হিসাব-নিকাশ করা হয়। দেখা গেলো ১৪ আগস্ট বাংলাদেশে জ্যোৎস্না রাত হবার সম্ভাবনা আছে।

অন্যদিকে ১৫ আগস্ট দিবাগত রাতে বাংলাদেশের উপকূলীয় ও নদীবন্দর এলাকাগুলোতে ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। এই ধরনের দুর্যোগপূর্ণ রাত কমান্ডো হামলার জন্য উপযুক্ত। কারণ দুর্যোগপূর্ণ সময়ে জাহাজের সেন্ট্রিরাও পাহারা শিথিল করে। এই কারণেই ১৫ আগস্ট রাতে অপারেশনের সময় ঠিক করা হয়েছিল। তবে এসব তথ্য আমি পরে জেনেছি।

‘অপারেশন জ্যাকপট’ এতোই গোপনীয় অপারেশন ছিল যে মূল পরিকল্পনাকারীরা ছাড়া এর স্থান, তারিখ বা সময় সম্পর্কে অপারেশনে অংশ নেয়া নৌকমান্ডোরা কেউ কিছুই জানতেন না। এমনকি আমরা এও জানতাম না যে ওই একই রাতের একই সময়ে একসঙ্গে চট্টগ্রাম, মংলা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং দাউদকান্দি বন্দরে সিরিজ আকারে লিমপেড মাইন হামলা পরিচালিত হবে।

কিন্তু কমান্ডোদের কাছে তো কোনো অয়্যারলেস নেই। তাহলে তারা আক্রমণের নির্ধারিত তারিখ ও সময় বুঝবে কী করে? কমান্ডোদের নির্দেশনা দেয়ার জন্য আমাদের সমর বিশারদরা একটি অভিনব পন্থা বের করেছিলেন। সেটা হলো ওই যে ক্যাপ্টেন দাশ আমাকে পঙ্কজ মল্লিক আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের দুটি গান শুনিয়েছিলেন। সেই গানগুলোই হবে আমাদের জন্য যুদ্ধযাত্রার সংকেত।

আমরা যারা অপারেশনের দলনেতা ছিলাম তাদের বলা হয়েছিল আকাশবাণী কোলকাতা বেতারে অন্যান্য গানের সঙ্গে যদি প্রথম গানটা অর্থাৎ ‘আমি তোমায় যতো শুনিয়েছিলাম গান তার বদলে চাইনি কোনো প্রতিদান’ গানটি বাজে তাহলে বুঝতে হবে ‘গেট রেডি’।

অর্থাৎ সব কিছু চেক করে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। আমাদের বলা হলো আকাশবাণী কোলকাতা কেন্দ্র থেকে গান দুটি বাজবে সকাল ৯ থেকে ১০টা এবং সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৯টায়। তাই অপারেশনে রওনা দেয়ার পর থেকে আমি নিয়ম করে ওই দুই সময়ে ট্রানজিস্টার শুনতাম। আর সহযোদ্ধারা ভাবতেন আমি হয়তো সময় কাটানোর জন্য গান শুনছি। আসলে উদ্দেশ্য তো ভিন্ন।

হঠাৎ একদিন আমি বেতারে ‘গেট রেডি’র সিগন্যাল গানটি শুনলাম। বুঝলাম অপারেশনের তারিখ সামনেই। কিন্তু আমার সহযোদ্ধা কাউকে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হওয়া সম্পর্কিত কিছু জানালাম না। শুধু আমার ডেপুটি কমান্ডারকে বললাম, ‘মতি আমাদের টার্গেট তো দাউদকান্দি ফেরিঘাট। চলো জায়গাটা রেকি করে আসি।’ হুজুরকে বললাম ‘দাউদকান্দি ফেরিঘাটের দিকে ঘুরে আসতে চাই।’

তিনি আমাদের জন্য একটা ছইওয়ালা নৌকা ভাড়া করে দিলেন। আমি আর মতি রওনা দিলাম। আমাদের বেশভূষা গ্রামের বেপারীদের মতো। একটু পান খাচ্ছি। সঙ্গে রাখা একটি চটের ব্যাগে স্টেনগানটা লুকিয়ে রেখেছি। বন্ধরামপুর থেকে ৬ কি.মি. দূরে হলো দাউদকান্দি ফেরিঘাট। আমাদের টার্গেট পয়েন্ট। পুরোটা পথ নৌকায় গেলাম। মেঘনা নদীর দ্বিতীয় শাখাটি বয়ে গেছে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে।

আর গোমতী নদী পূর্ব থেকে পশ্চিমে গিয়ে যেখানে মেঘনার দ্বিতীয় শাখার সঙ্গে মিলিত হয়েছে সেই সঙ্গমস্থলেই দাউদকান্দি ফেরিঘাট। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যেখানে দাউদকান্দি ব্রিজটি নির্মিত হয় তার থেকে দুই কি.মি. উত্তরে ছিল দাউদকান্দি ফেরিঘাট ও বাজার। ফেরিঘাটের আশপাশটা পর্যবেক্ষণ করে দেখি একটি ফেরি পন্টুনের সঙ্গে বাঁধা আর একটি কিছুদূরে নদীতে নোঙর করা।

ফেরিগুলো ছোট আকারের। ১০-১৫টা গাড়ি পার হতে পারে এমন আকারের দুটি ফেরি। টার্গেটে হিট করার জন্য আমরা নয়জন নৌকমান্ডো আছি। সিদ্ধান্ত নিলাম একেকটি ফেরিতে তিনজন কমান্ডো মাইন স্থাপন করবেন। আমি দলনেতা হিসেবে পন্টুন উড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিয়ে বাকিদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দিলাম। এসব দেখে নিয়ে ফেরিঘাট থেকে আমরা মেঘনা নদীর দ্বিতীয় শাখা দিয়ে আরো ২ কি.মি. উত্তরে গেলাম। নদীতে তখন অথৈ পানি। পশ্চিম দিকে বড় চর জেগেছে আর পূর্ব দিকে মেঘনার তীর ঘেঁষে ধানক্ষেত।

ধানক্ষেতগুলোও পানিতে ভরে গেছে। মতিকে বললাম ‘চলো পানিতে নামি। স্রোতটা কেমন বোঝা দরকার।’ গ্রামের বেপারীরা নদীপথে যাতায়াতের সময় এরকম নৌকা থামিয়ে গোসল করে। আমাদের অঞ্চলে একে বলে ‘বোর দেয়া’। আমরা গামছা পরে পানিতে নেমে দেখি পানিতে স্রোত তেমন বেশি না। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা যদি এই ধানক্ষেতে নৌকা নিয়ে এসে টার্গেটে হিট করতে নদীতে নামি তাহলে রেসকিউ পার্টির জন্য এই পানিপূর্ণ ধানক্ষেতে অস্ত্র হাতে পজিশন নেয়ার কোনো শুকনো স্থান নেই।

তাছাড়া টার্গেটে হিট করার পর মেঘনা নদীর দ্বিতীয় শাখাটি সাঁতরে ওই একই পথে আবার ধানক্ষেতে ফিরে আসাটা নৌকমান্ডোদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। আবার টার্গেটে হিট করে আমরা যদি আরো দক্ষিণ দিকে চলে যাই তাহলে ওদিকে হয়তো ওঠার জন্য শুকনো জায়গা পাবো। কিন্তু সেক্ষেত্রে সমস্যা হলো তখন আমাদের গ্রামের ভেতর দিয়ে এসে গোমতী নদীর তীরঘেঁষে পূর্ব-পশ্চিমে চলে যাওয়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পার হয়ে এরপর গোমতী নদী সাঁতরে ধানক্ষেতে অবস্থান করা রেসকিউ পয়েন্টে আসতে হবে।

অপারেশনের পর তখন একে তো আমরা সবাই থাকবো অর্ধনগ্ন অবস্থায়। সঙ্গে কোনো অস্ত্রও থাকবে না। কারণ নির্দেশ মতো কমান্ডো নাইফটা আপারেশনের পরে নদীতে ফেলে দিয়ে আসতে হয়। আর এতোগুলো অর্ধনগ্ন যুবক ছেলেকে দেখে গ্রামবাসী যদি ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলে অথবা কেউ যদি পাকিস্তান আর্মির ক্যাম্পে খবর দেয় তাহলেই আমরা শেষ।

তাই সবদিক বিবেচনা করে আমার কমান্ডারদের নির্দেশিত পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন আনলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম দাউদকান্দি ফেরিঘাটের উত্তরে মেঘনা নদীর তীরে ধানক্ষেতে লগি দিয়ে নৌকা বেঁধে রাখবো। এরপর স্রোতের অনুকূলে সাঁতার কেটে আমরা টার্গেটে হিট করবো। হিট করার পর আবার স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কেটে ধানক্ষেতে বেঁধে রাখা নৌকায় উঠবো। এই পরিকল্পনা করে সেদিনের মতো ফিরে আসলাম।

রেকি শেষে অপেক্ষা করছিলাম কবে শুনবো সেই গান। অবশেষে এলো ১৯৭১ এর ১৫ আগস্টের সেই প্রতীক্ষিত ক্ষণ ‘অপারেশন জ্যাকপট’। ১৪ আগস্ট রাত ৯টায় আকাশবাণীতে শুনতে পেলাম ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি। ওরে, তোরা উলুধ্বনি সব কর’। আমি বুঝে গেলাম অপারেশনে যেতে হবে। গান প্রচারের সময়ের সঙ্গে হিসাব করে বের করলাম ১৫ আগস্ট দিবাগত রাত ১টা থেকে ২টার মধ্যে টার্গেটে হিট করতে হবে।

সে অনুযায়ী পরদিন দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার শেষে হুজুরকে বললাম, ‘আমাদের একটা নৌকা ঠিক করে দেন।’ হুজুর একটা বড় সাইজের কোষা নৌকা মাঝিসহ জোগাড় করে দিলেন। সন্ধ্যার পরে আমরা সারা গায়ে সরিষার তেল মেখে সুইমিং কস্টিউম পরে কমান্ডো নাইফ, মাইন আর স্টেনগান নিয়ে রওনা হলাম। সঙ্গে রইলেন আমাদের মাঝি আর দুইজন গাইড।

কিছুদূর যাওয়ার পরে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। নৌকা আর এগুতে পারছে না। এরই মাঝে আমাদের মাঝি আর গাইড রাস্তা হারিয়ে ফেললো। তখন একটা গ্রামে গিয়ে নৌকা ভেড়ালাম। গ্রামের লোকজন তো তখন ঘুমাচ্ছে। নৌকা থেকে নেমে একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, দাউদকান্দি যাওয়ার রাস্তাটা কোনদিকে?’

গ্রামের লোকজন আমাদের কথার জবাব না দিয়ে ডাকাত সন্দেহ করে চেঁচামেচি শুরু করলো। বিপদ দেখে তাড়াতাড়ি নৌকা নিয়ে ধানক্ষেতে চলে আসলাম। পরে জেনেছিলাম গ্রামটি রাজাকার অধ্যুষিত। গ্রামের নাম মোহাম্মপুর। তারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধা বা বিচ্ছু বাহিনী সন্দেহ করেই চেঁচামেচি করেছিল।

এরপর দেখলাম দাউদকান্দি শহরের বৈদ্যুতিক বাতির আলোর রেখা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। আমরা সেই আলোর রেখা ধরে এগুতে থাকলাম। এর মধ্যেই সুবেহ সাদেকের সময় হয়ে গেলো। পূর্ব আকাশ ফর্সা হয়ে উঠলো। গাইডরা আমাদের মতো ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছিলেন না। তাই বৃষ্টিতে ভেজার কারণে মান্নান নামের একজন গাইডের ভীষণ জ্বর এসে গেলো। তিনি শীতে ঠকঠক করে কাঁপছিলেন।

কিছু দূরে অন্য একটি গ্রামের দিকে গিয়ে বড় একটা পাটের নৌকা দেখতে পেলাম। ওই নৌকা থেকে কিছুটা দূরে আমাদের নৌকাটি দাঁড় করালাম। দেখলাম ওই নৌকার লোকজন সবাই ঘুমাচ্ছেন। মান্নান বললেন, ‘আমাকে এখানেই নামিয়ে দেন। আমি ওই পাটের নৌকায় করে চলে যাবো।’

একথা শুনে আমি মতি ও অন্য কমান্ডারদের সঙ্গে কথা বললাম। সবাই বললো মান্নানকে এখানে রেখে যাওয়া মানে আমাদের সকলের ধরা পড়া। কারণ আমাদের শত্রুরা তাকে ধরে পিটুনি দিলেই সে বলে দেবে কোথায় আমাদের আস্তানা, কে কী করেছে। পাশাপাশি আমি তখনো জানি না এই একটি গানের সংকেতের মাধ্যমে পুরো বাংলাদেশের ৫টি জায়গায় হামলা হচ্ছে। তবে আমি এমন কিছুর ধারণা করেছিলাম।

এই পরিস্থিতিতে মান্নান ধরা পড়ে গেলে আমাদের বাকি গ্রুপগুলোর অপারেশনও বানচাল হয়ে যাবে। তাই আমি প্রস্তাব করলাম মান্নানকে গুলি করে মারলে শব্দ হবে। তার চেয়ে ভালো কমান্ডো নাইফ দিয়ে তাকে হত্যা করে লাশটা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া। কিন্তু সুবেহ সাদেক হয়ে যাওয়া এখন আমাদের জন্য অপারেশন করাও কঠিন। তাই আমরা বিফল মনোরথে আবার নৌকা নিয়ে ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে বন্দেরামপুরে আল্লামা শাহ কামাল হুজুরের বাড়িতে ফিরে আসলাম। তখন সকাল ৬টা বা ৭টা বেজে গেছে। সারাদিন মন খারাপ রইলো।

হুজুরকে বললাম, ‘হুজুর আপনি আমাদের মোটামুটি সাইজের একটা ছইয়া নৌকা ঠিক করে দেন। যাতে ঝড়বৃষ্টি হলে আমাদের গাইডরা কাবু হয়ে না পড়ে। আর সঙ্গে ছোট একটা কোষা নৌকা দেন।’ আমরা আবার ১৬ আগস্ট সন্ধ্যার পর দাউদকান্দি ফেরিঘাটের উদ্দেশে রওনা দিলাম। ওইদিন ঝড়বৃষ্টি হলো না। পরে জেনেছি বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া যৌথ কমান্ডের সেনানায়করা অনেক হিসাব করে কমান্ডো হামলার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ঝড়ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ ১৫ আগস্ট রাতকেই বেছে নিয়েছিলেন।

১৬ আগস্ট রাতে দাউদকান্দিতে যেতে আমাদের কোনো সমস্যাই হলো না। দাউদকান্দি ফেরিঘাটের দুই কি.মি. আগেই ধানক্ষেতের ভেতরে বড় ছইওয়ালা নৌকাটা লগি দিয়ে বাঁধলাম। এরপর আমরা নয়জন কমান্ডো কোষা নৌকা নিয়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেলাম। ফেরিঘাট থেকে আধা কিলোমিটার আগেই নদীতে কোষা নৌকাটি বেঁধে আমরা একে একে পানিতে নেমে পড়লাম।

যেহেতু কোষা নৌকা আর ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত তাই শত্রুদের পক্ষে আধা কি.মি. দূর থেকে কোষা নৌকাটিকে দেখতে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। নিয়ম হচ্ছে টার্গেটকৃত জাহাজের সম্মুখ অংশে একটা, মাঝখানে একটা এবং শেষ প্রান্তে একটা মাইন স্থাপন করতে হয়। তাই আমি তিন জন কমান্ডোকে পাঠিয়ে দিলাম দূরের ফেরির দিকে। তিন জনকে পাঠালাম ঘাটের কাছের ফেরির দিকে। আর বাকি দুজনকে সঙ্গে নিয়ে আমি গেলাম ফেরির জেটি অর্থাৎ পল্টুনে মাইন স্থাপন করতে।

আমি ছিলাম পন্টুনের উত্তর দিকে। মাইন লাগানোর সময় কষ্টকর বিষয় হলো জাহাজের নিচে জমে থাকা শ্যাওলা পরিষ্কার করা। এটা অনেক সময় একবারে পরিষ্কার হয় না। তখন বারবার নিঃশব্দে পানির ওপরে ভেসে উঠে শ্বাস নিয়ে আবার পানির নিচে গিয়ে কাজটি শেষ করতে হয়। আর পায়ের ফিন্স অনবরত নাড়িয়ে পানির স্রোতের বিপরীতে টিকে থাকতে হয়।

কাজটি খুবই শ্রমসাধ্য। মাইন লাগানো শেষে আমাদের রেসকিউ পয়েন্ট কোষা নৌকায় ফিরে আসলাম। ট্রেনিংয়ের সময় জেনেছিলাম কোনো যোদ্ধা যদি মাইন লাগানো শেষ করে তার রেসকিউ পয়েন্টে যাওয়ার পথ হারিয়ে ফেলেন তাহলে তিনি পানির ওপর দুই হাত তুলে নিঃশব্দে হাততালি দেয়ার মতো সাইন দেখাবেন। দলনেতা ওই সাইন দেখে তাকে রেসকিউয়ের জন্য নিজে যাবেন অথবা অন্য কমান্ডোকে পাঠাবেন।

আমার এক সহযোদ্ধা কমান্ডো এই সাইন দেখালে ডেপুটি কমান্ডার মতিকে পাঠিয়ে দিলাম তাকে পথ দেখিয়ে ফিরিয়ে আনার জন্য। এই সময় আমি একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম। কারণ তিনি যদি পথ হারিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন তাহলে তার মৃত্যু তো হবেই সেই সঙ্গে তার কাছ থেকে আমাদের সব তথ্য আদায় করে আমাদেরও বিপদের মধ্যে ফেলবেন।

যাই হোক নিরাপদেই মতি তাকে গাইড করে নৌকায় ফিরিয়ে আনলো। আমি তাকে দেখে অতিরিক্ত উত্তেজনায় হাত বাড়িয়ে তুলতে গেলাম। কিন্তু পিচ্ছিল বলে নৌকার ওপরে নিজেই পড়ে গেলাম। এরপর আমাদের ছইওয়ালা নৌকায় ফিরে এসেই দ্রুত নৌকা ছেড়ে দিলাম। এখন আমরা নিরাপদ। বড়জোর আধা কিলোমিটার এসেছি। এমন সময় আমাদের লাগিয়ে আসা মাইনগুলো আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে বিকট শব্দে একের পর এক বিস্ফোরিত হতে লাগলো।

মাইন বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই শুনলাম পাকিস্তান হানাদার বাহিনী পশ্চিম দিকে সমান তালে টু-ইঞ্চি, থ্রি-ইঞ্চি মর্টারের গোলা, মেশিনগান ও রাইফেলের গুলি ছুড়ছে। ওরা ভেবেছে ঢাকার দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এসে হামলা করেছে। আসলে আমরা তো গিয়েছিলাম উত্তর দিক থেকে। পাকিস্তানিরা তা ধারণাও করতে পারেনি। আমাদের নৌকা এগিয়ে চললো বন্ধরামপুরের শাহ কামাল হুজুরের বাড়ির দিকে।

একটু পর মুখে হাত দিয়ে দেখি পানির মতো কি জানি! আরো কিছু দূর যাওয়ার পরে সিগারেটের তৃষ্ণা পেলো। কিন্তু যুদ্ধের সময় আগুন জ্বালানো নিষেধ। তাই আরো কিছুদূর যাওয়ার পর সিগারেট ধরালাম। আগুনের আলোয় দেখলাম আমার ডান পাশের দাঁতের ওপরের পাটির মাড়ি ও ঠোঁটের ওপরে কেটে গেছে। দেখে খুব একটা গা করলাম না। ফজরের আজান হয়ে যাওয়ার একটু পরে আমরা শাহ কামাল হুজুরের বাড়ির ঘাটে এসে পৌঁছলাম।

ঘাটে নেমেই দেখি হুজুর পায়চারি করছেন। আমাদের দেখেই বললেন, ‘পুত (ছেলে) তোরা আইছস। গজবের মতো আওয়াজ শুইনা তো আমি মনে করছিলাম, পুতগোরে পাডাইলাম যুদ্ধ করতে। না জানি ওরা কী বিপদে পড়ছে! আল্লাহ! ওদের রহম কইরো।’ আমি হুজুরের কথা শুনে হেসে বললাম, ‘এই গজবের মতো আওয়াজ তো আফনের পুতেরাই কইরা আইছে।’

শুনে তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। এরপর তিনি বললেন, ‘শোন পুত। কয়েকদিন আগে আমার এক মুরিদান এই দাউদকান্দি ফেরিঘাটের পাশ দিয়া নৌকায় কইরা নারায়ণগঞ্জ থাইকা পাট বেইচা আসছিল। সেই সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর রাজাকাররা তার নৌকা আটকে ঘাটে নিয়া আসে। তার কাছে টাকা চায়। সে দিতে না চাইলে তাকে অমানুষিক নির্যাতন করে।

একপর্যায়ে তাকে দিগম্বর করে তার কাপড়ের নিচের থলেতে রাখা টাকা নিয়া যায়। সেই মুরিদ এসে কেঁদে কেঁদে আমাকে তার ঘটনা বললে আমি আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে দোয়া করছি, হে আল্লাহ এই জালিম অত্যাচারীদের ওপর তুমি গজব নাজিল করো। আজকে আল্লাহ তোর মাধ্যমে সেই গজব নাজিল করছেন।’

(সূত্র : '৭১ বীরত্ব বীরগাথা বিজয়'- বইয়ের প্রথম খণ্ড থেকে সংগৃহীত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে