মাওলানা ভাসানী ছিলেন উপমহাদেশের রাজনীতির এক অনন্য ব্যক্তিত্ব এবং মজলুম জনতার কণ্ঠস্বর। তাঁর জীবন ও সংগ্রাম বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায়।
১. প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষাজীবন
মাওলানা ভাসানীর জন্ম ১৮৮০ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে, এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। তাঁর পিতার নাম হাজী শরাফত আলী। ছোটবেলায় তিনি স্থানীয় মক্তবে আরবি, ফারসি ও ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং ইসলামি চিন্তাধারায় গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তাঁর শিক্ষাজীবন তাকে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে উদ্বুদ্ধ করে।
২. রাজনীতিতে প্রবেশ
মাওলানা ভাসানী ১৯২০-এর দশকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি কৃষক-প্রজাদের দুঃখ-কষ্টের কথা গভীরভাবে উপলব্ধি করে তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যুক্ত হন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তার নেতৃত্বে কৃষকরা সংগঠিত হন এবং তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সোচ্চার হন।
২.১. কৃষক প্রজা পার্টি
১৯৩০-এর দশকে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক প্রজা পার্টি গঠিত হলে মাওলানা ভাসানী তাতে সক্রিয় অংশ নেন।
২.২. আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা (১৯৪৯)
ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তান গঠিত হলে পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মাওলানা ভাসানী আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এর প্রথম সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে আওয়ামী লীগের নাম থেকে “মুসলিম” শব্দটি বাদ দেওয়ারও প্রস্তাব দেন।
৩. ভাসানীর আন্দোলন ও কাগমারী সম্মেলন (১৯৫৭)
১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলন ছিল মাওলানা ভাসানীর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এখানে তিনি পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশ্যে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। এই সম্মেলনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেন, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি তৈরি করে।
৪. ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (NAP)
১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (NAP) প্রতিষ্ঠা করেন। এই দল সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিল। মাওলানা ভাসানী মজলুম জনতার নেতা হিসেবে পরিচিত হন।
৫. কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন
মাওলানা ভাসানী সবসময় কৃষক ও শ্রমিকদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তিনি জমিদারি প্রথার বিরোধিতা করেন এবং ভূমিহীন কৃষকদের জমির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেন। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করেন।
৬. স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা
মাওলানা ভাসানী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেন। পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র প্রতিবাদ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিল।
৭. ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ
মাওলানা ভাসানীর ব্যক্তিত্বে ছিল দৃঢ়তা, নৈতিকতা ও মানবতার মিশেল। তিনি কখনোই ক্ষমতা বা স্বার্থপরতার রাজনীতিতে লিপ্ত হননি। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে সমাজতন্ত্র ও ইসলামি মূল্যবোধের সমন্বয় ছিল।
৮. মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
মাওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি আজও “মজলুম জননেতা” নামে স্মরণীয়।
মাওলানা ভাসানীর প্রভাব
মাওলানা ভাসানী একজন চিরজাগ্রত বিপ্লবী নেতা। তিনি ব্রিটিশ, পাকিস্তানি ও সবধরনের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তাঁর জীবন ও আদর্শ নতুন প্রজন্মের জন্য প্রেরণা।
“মাওলানা ভাসানী ছিলেন গণমানুষের নেতা, যিনি সব সময় শোষিত ও বঞ্চিতদের পক্ষে লড়াই করেছেন।”