ডিসেম্বর। আমাদের বিজয়ের মাস। বাঙালির গৌরবের মাস। পরাধীনতার শেকল ভেঙে মুক্ত হওয়ার মাস। এই বিজয় ছিনিয়ে আনতে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে মুক্তিকামী বাংলার জনগনকে। শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হয়েছে নির্ভীক চিত্তে। স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে অানতে বুকের তাজা রক্তে রাঙাতে হয়েছে মাতৃভূমিকে। বিজয়ের মাসে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের গৌরবগাথার টুকরো কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলাে এ প্রজন্মের পাঠকদের জন্য-
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ১১ নং সেক্টরের মানকারচর সাব- সেক্টরের রঞ্জু কোম্পানীর নামকরন হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুব এলাহী রঞ্জুর নামে। স্বাধীনতা যুদ্ধে মাহবুব এলাহী রঞ্জু ১১-নম্বর সেক্টরের রঞ্জু কোম্পানির কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই মুক্তিযোদ্ধার জন্ম গাইবান্ধা শহরের মুন্সিপাড়ায়। বাবা মরহুম ফজলে এলাহী। মা মরহুম মেহেরুন্নেছা। চার ভাইবোনের মধ্যে বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। ১৯৭০ সালে এইচএসসি পাশ করেন রাজশাহী গভর্মেন্ট কলেজ থেকে। একই বছরের আগস্ট মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বিশ্বাবিদ্যালয়ে ছেড়ে চলে যান যুদ্ধে যোগ দিতে। দীর্ঘ নয় মাসের সাহসিকতা দেখে বাংলাদেশ সরকার এই বীরকে “বীর প্রতীক সম্মানে ভূষিত করেন।
………………………………….
৯ আগস্ট রাতে আমরা কালা সোনার চরে আসলম। ১০ আগস্ট সকালে সংবাদ আসলো আমাদের কাছে এখানে রাজাকাররা এসে ভীষণ লুটপাট করছে। সংবাদ পেয়ে আমরা নদীর পাড়ে এসে দেখি ঘটনা সত্যি। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আক্রমন করবো। একটা পর্যায়ে আমরা আবার ফিরে এসে অস্ত্র নিয়ে নদীর পাড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি রাজাকারগুলো অবস্থান নিয়েছে ছোট নদীর পশ্চিম পাড়ে। অর্থাৎ আমাদের ব্রহ্মপুত্র নদীটা পিছনে পাড়ি দিয়ে এসে চর।
চরের আবার পশ্চিম প্রান্তে আছে একটা ছোট্ট নদী। ছোট নদীটা পাড়ি দিলেই আমাদের রতনপুর। রতনপুর থেকে গাইবান্ধা কাছে। আমরা ওদের উপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে গুলি করা শুরু করলে ওরা নদীর ওপারে সরে যায়। তারপর আমরা তাড়াতাড়ি করে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে সবাই পাড়ি দিয়ে নদীর পশ্চিম পাড়ে এলাম। নদীর উপরে গিয়ে দেখি যে কেউ নাই, সাড়াশব্দ নাই। হঠাৎ আমাদের কয়েকজন হ্যান্ডস-আপ বলে জোরে চিৎকার করে উঠল।
রাজাকাররা ওখানে লুকিয়ে ছিল। মুহুর্তে দুজন রাজাকারকে ধরে ফেলা হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা প্রায় ১২জন রাজাকারকে ধরে ফেললাম। ওদেরকে বাধা হল। পরে জানা গেলো আরো দুইজন রাজাকার ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমে বাঁধের গোড়া দিয়ে পালানের সময় স্থানীয় জনগন আক্রোশের মুখে পড়ে এবং জনগন তাদেরকে মেরে ফেলেছে। তাদের অস্ত্রগুলো জনগন আমাদের কাছে নিয়ে আসে।
আমরা আরো জানতে পারলাম দুজন রাজাকারকে দুই টুকরা করে ফেলছে স্থানীয়রা। আমি অবাক হলাম সেই মুহূর্তে মানুষের আক্রোশের পরিমান চিন্তা করে। এই দিন রাজাকারদের কাছ থেকে আমাদের অস্ত্র জোগাড় হলো ১৬টা। রাজাকার ধরলাম ১২টা আর দুইজনকে মারল গ্রামবাসী। সবাই জানালো রাজাকার ছিলো ১৬ জন । তখন সবার চিন্তা হলো বাকী দুই রাজাকার কোথায়? আমরা ধারনা করলাম তারা পালিয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আমি সেদিন নিশ্চিত ছিলাম আজকে এখানে পাকিস্তান সেনাবাহির্নী আসবেই। আমাদের সঙ্গে তাদের লড়াই হবে।
ঠিক যা ধারনা করলাম তাই হলো । ১০ আগস্ট বিকাল বেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনী চলে এলো। আমরা ছোট্ট মানস নদীর পূর্ব তীরে বিভিন্ন ঘাস-কালাইয়ের জঙ্গলে পজিশন নিয়ে আছি। ওরা পশ্চিম তীরে এসে একটু ঘোরাঘুরি করলো। একটা পর্যায়ে তারা আমাদের অস্তিত্ব টের পেয়ে মুহুর্তে অবস্থান নিয়ে গোলাগুলি করলো। আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে কোন গুলি না করে চুপচাপ রইলাম। একটু কৌশলী হলাম কারন আমি বুঝতে পারছিলাম এই অসময়ে গোলাগুলি করলে খুব একটা ভালো কোন ফলাফল হবে না।
কারণ নদীর এপার-ওপার যুদ্ধ করে কি লাভ? মাঝখান থেকে শুধু আমার গোলাবারুদ নষ্ট হবে। একটু পরেই দেখলাম ওরা আস্তে আস্তে ক্রলিং করে পিছে হটছে। ওদের মনে সন্দেহ যে আমরা আছি। ওরা পিছু হটে চলে গেলো। পরবর্তীতে আমরা জেনেছি পাকিস্তান সেনাবাহিনী সন্ধ্যা হলেই বাইরে কোথাও থাকত না। যেহেতু সন্ধ্যা হয়ে আসছে ,বিকাল পাঁচটা বেজে যাচ্ছে তাই তারা তাড়াতাড়ি করে ফিরে গেল তাদের ক্যাম্পে ।
এদিকে গাইবান্ধার পূর্ব পাশে ব্রহ্মপুত্র নদী। ব্রহ্মপুত্র নদীর সমান্তরাল হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র বাঁধ। এই বাঁধের রসুলপুরে ওদের একটা ক্যাম্প আর ফুলছড়িতে একটা ক্যাম্প। ওই বাঁধের পূর্বদিকে ব্রহ্মপুত্র নদী। ব্রহ্মপুত্র নদীর পূর্ব পাশ দিয়ে বিস্তর এলাকা তারপরে মানকারচর। কিন্তু বর্ডার আর তখন মানকার চরে নাই। ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম পাড়টাই তখন বর্ডার হয়ে গেছে। ব্রহ্মপুত্রের বাঁধটাই পাকিস্তানী বাহিনীর সীমান্ত।
পরবর্তীকালে উত্তর কামারজানি, রসুলপুর, রতনপুর এবং ফুলছড়ি- গাইবান্ধার এই চারটি স্থানে ক্যাম্প করেছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তবে এই আক্রমনের সময় শুধু উত্তরে রসুলপুর এবং দক্ষিণে ফুলছড়িতেই তাদের ক্যাম্প ছিল। এই পাকিস্তান সেনাবাহিনী এসেছিলো উত্তরে রসুলপুর ক্যাম্প থেকে। পরের দিন আমি একদম নিশ্চিন্ত যে আজকে পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হবে। অনুমান ঠিক।
ভোর বেলাতেই ওরা চলে আসলো। ফুলছড়ি ও রসুলপুর দুই দিকেই থেকে ওরা আসছে। আমাদের কিন্তু ধারণা ছিল না তারা এমন করে দুদিক থেকে আসবে। বর্বর পাকিস্তান বাহিনী এসেই হামলা চালালো নিরহ গ্রামবাসীর উপর। সারা রতনপুর গ্রামে আগুন লাগিয়ে দিলো। গ্রামের বেশিরভাগই সাধারণ কুঁড়ে ঘর। নদীর পাড়ের মানুষগুলো তখনকার দিনে খুব গরিব ছিল। সে কী বিভৎস অবস্থা! কিন্তু আমাদের তো ঐ মুহুর্তে কোনকিছু করার নাই।
আমরা ভালো করে কোন তথ্য পাই নাই। বুঝতে পারছি না তারা কতজন আছে? তবে আমরা নিশ্চিত হয়ে গেলাম পাকিস্তানিদের আক্রমণ করব। সকাল থেকে আমাদের কোন দানা পানি পড়েনি পেটে। নদীর পাড়ে আমরা পজিশন নিয়ে বসে আছি। বেলা ১২টা সাড়ে ১২.৩০ দিকে আমরা ওদের অবস্থানটা বুঝতে পারলাম। খবর পেলাম মানস নদীর পশ্চিম পাড় দিয়ে ওরা হেঁটে আসছে। ওরা আসছে দুটো নৌকা ও নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে।
দেখলাম নৌকার ছইয়ের মধ্যে পাকিস্তানী সেনারা বসে পা দোলাচ্ছে আয়েশী ভঙ্গিতে অস্ত্রটা উঢ়ুঁ করে ধরে। দুই নৌকা ভরা পাকিস্তানি সৈন্য। নৌকার গলুই ও ছইয়ের অগ্রভাগে তারা বসা আর্মস নিয়ে। বাকীরা হেঁটে যাচ্ছে। আমাদের কয়েকজন মাঝি তাদের গুন টানছে। সিদ্ধান্ত নিলাম গুলি করবো কিন্ত কোন অবস্থাতেই যেন যে লোকগুলো গুন টানছে তাদের গায়ে গুলি না লাগে। তখন আমাদের একটা পদ্ধতি ছিলো আমি একজনকে কথাটা বললাম সে আরেকজন বললো এভাবে মুহূর্তেই কথাটা প্রচার হয়ে গেল, মাঝিদের যেন গুলি না লাগে। এরপরে পাকিস্তানিরা উত্তরে যাচ্ছে আমরাও উত্তরের দিকে যাচ্ছি।
আমাদের সুবিধা হচ্ছে নদীর পাড় দিয়ে কালাইয়ের ঘন জঙ্গল। আমরা এই গাছগুলোর আড়াল দিয়ে ওদের সঙ্গে সঙ্গে এগুচ্ছি। সমান্তরালভাবে যাচ্ছি দুই দলই। এভাবে প্রায় দুই তিন মাইল পথ গিয়েছি। রতনপুর থেকে উড়িয়া পর্যন্ত গেছি। আমরা শুধু আক্রমনের সুবিধা খুঁজছি। আমাদের অবস্থানটা সুবিধাজনক না। ওরা উপরে আমরা নিচে।
ওরা আক্রমণ করলে সুবিধা করতে পারবে, আমরা পারব না। আর তাছাড়া নদী। এক সময় আমাদের সামনে আড়াআড়ি নদী পড়লো। চরের ভেতর থেকে একটা নালা এসে নদীতে পড়েছে। ইমান আলী নামের একজন সহযোদ্ধা আমার কানে কানে বললো ঐ নালাটা কিন্তু পার হতে পারব না। অনেক পানি।
নালাটা খুব ছোট না। পার হতে না পারলে তো শত্রু হাতছাড়া হয়ে যাবে। অতএব আর দেরি না এবার আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি শুধু একটু ইশারা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এলএমজি দুটো গর্জে উঠল। এলএমজি গর্জে উঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সমস্ত শক্তি দিয়ে ওদের উপর একযোগে আক্রমণ করলাম। সেখানে আমরা ছিলাম ২০ জন । মুহুর্তেই পাকিস্তানি সেনারা পাখির মতো লুটিয়ে পড়তে শুরু করল। ছইয়ে, গুলুইয়ে বসা যে সৈন্যগুলো ছিল তারা গুলি খাওয়া পাখির মতো লুটিয়ে পড়ল। আর বাকীগুলো পজিশন নিয়ে যুদ্ধ শুরু করল। প্রায় আধা ঘন্টা যুদ্ধ হলো। এক পর্যায়ে ওরা পিছু হটতে শুরু করল।
আধা ঘন্টা পর একটা পর্যায়ে ওদের কোন সাড়াশব্দ নাই। তখনো বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে! আমরা একদম পুরো পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করছি। আর ওদের নৌকাগুলো আস্তে আস্তে ভাসতে ভাসতে দক্ষিণে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না কী করব? হঠাৎ দেখি ওইখানে এসে এক গ্রামবাসী বলছে,‘ নাই নাই সব পালাইছে। মরছে। সব খতম।’ পাগলের প্রলাপের মতো সে নানান কথা বলতে শুরু করলো।
এরপর ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে সাহস করে প্রথম আমাদের সহযোদ্ধা নসিবর আর একাব্বর নদীটা পাড়ি দিল। নদীটা পাড়ি দিয়েই ওপারে যেয়ে নসিবর তার এসএলআর (সেল্ফ লোডিং রাইফেল) উঁচিয়ে ধরে চিৎকার করে উঠলো ‘জয় বাংলা।’ সে সময়ে আমাদের মূল শ্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’।
সূত্র : '৭১ বীরত্ব বীরগাথা বিজয়'- বইয়ের প্রথম খণ্ড থেকে সংগৃহীত