শামীমা আক্তার, ক.বি: সফল্যের পথ কুসুমাসত্বীরণ নয়, এ পথে ছড়ানো থাকে রাশি রাশি কাঁটা। এলাম, দেখলাম, জয় করলাম—কথাটা বোধকরি ব্যবসার ক্ষেত্রে যায় না। তাই কণ্টকাকীর্ণ পথ মাড়িয়েই রক্তমাখা পায়ে পৌঁছাতে হয় সাফল্যের বন্দরে। ড. মো. সবুর খান তেমনই একজন, যিনি শত বাধা ডিঙিয়ে এখন সফল উদ্যোক্তা, সফল ব্যবসায়ী ও শিক্ষানুরাগী। এখন তিনি হাজার হাজার তরুণের স্বপ্নের আইকন। তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে অনেক তরুণই হতে চান সফল উদ্যোক্তা। কিন্তু সাফল্যের পথ তো এত সহজ নয়। তবে কতটা কঠিন? সেটা ড. মো. সবুর খানের জীবনের দিকে তাকিয়ে কিছুটা উপলব্ধি করা যাক, চলুন।
গত শতকের নব্বুই দশক। একজন পরম্পরা উদ্যোক্তা ও স্বনির্মিত ব্যবসায়ী হিসেবে যাত্রা শুরু করেন ড. মো. সবুর খান। ১৯৯০ সালে ড্যাফোডিল কম্পিউটার্স লিমিটেড নামে একটি পাবলিক তালিকাভূক্ত আইটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যবসা জগতে পা রাখেন তিনি। ব্যবসাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নই তাঁর অন্যতম লক্ষ্য। তিনি তাঁর সকল মেধা, অভিজ্ঞতা ও কর্মস্পৃহাকে নিবদ্ধ করেছেন তথ্যপ্রযুক্তি ও শিক্ষার বিকাশে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার পাশাপাশি স্বনির্ভর আগামী প্রজন্ম তৈরির লক্ষ্যে তিনি দেশ ও দেশের বাইরের চাহিদাসম্পন্ন দক্ষ তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তৈরিতে নিজের আইটি মেধা ও শিক্ষাকে বিনিয়োগ করেছেন। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার জীবনে মো. সবুর খান বিশ্বের পঁচিশটি দেশে ড্যাফোডিল গ্রুপের অধীনে একের পর এক শাখা স্থাপন করেছেন। এছাড়া তিনি এক ডজনেরও বেশি বৃহত্ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত, যেগুলো সাফল্যের সঙ্গে শিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তিখাতে সেবা ও সমাধান প্রদান করছে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কেমন অবদান রেখেছেন বা রাখছেন ড. মো. সবুর খান? ১৯৯১ সালে তিনি অ্যাসেমব্লেড কম্পিউটারের সূচনা করেন। ১৯৯৫ সালে দেশের প্রথম সুপার স্টোর ধারনার প্রবর্তন করেন। এরপর ১৯৯৬ সালে ড্যাফোডিল ইনস্টিটিউট অব আইটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৭ সালে দেশের প্রথম ব্র্যান্ড কম্পিউটার ‘ড্যাফোডিলপিসি’ বাজারজাত করেন। এছাড়াও ড. মো. সবুর খান দেশের প্রথম চাকরি খোঁজার অনলাইন পোর্টাল জবস বিডি ডটকম, আইএসপি ড্যাফোডিল অনলাইন লিমিটেড, সম্পূর্ণ ডিজিটাল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, কস্পিউটার ক্লিনিক, বাংলাদেশ স্কিল ডেভলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (বিএসডিআই), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল প্রফেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ড্যাফোডিল ইনস্টিটিউট অব আইটি (ডিআইআইটি), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি (ডিআইএ), বাংলাদেশ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল লিমিটেড (বিভিসিএল) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন। এসবই বলে দেয় বাংলাদেশের প্রযুক্তিখাতে তার অবদান কতোটা সুদুরপ্রসারী।
ড. মো. সবুর খান ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি টাস্ক ফের্সের সদস্য, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইয়ের চৌষট্টি জেলায় শিল্পায়নের স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রনালয় প্রতিষ্ঠা, আইটি ইনকিউবেটর স্থাপন, বিসিএস কম্পিউটার সিটি (আইডিবি) প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কাজে অসামান্য অবদান রাখেন। সম্প্রতি তিনি তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্বুদ্ধ করতে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। ড. মো. সবুর খান বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাঞ্জেল নেটওয়ার্কের (বিবিএএন) একজন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি অতি সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড বিজনেস অ্যানজেল ইনভেস্টমেন্ট ফোরাম বাংলাদেশের হাইকমিশনার নিযুক্ত হয়েছেন।

সমাজ উন্নয়নেও অবদান রাখছেন ড. মো. সবুর খান। তিনি ড্যাফোডিল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দারিদ্র্য দুরীকরণে নিরলস প্ররিশ্রম করে যাচ্ছেন। ভারতের কলিঙ্গ ইনস্টিটিউট অব সোস্যাল সায়েন্সের (কেআইআইটি) সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করেছেন ড্যাফোডিল ইনস্টিটিউট অব সোস্যাল সায়েন্স (ডিআইএসএস)। সমাজ উন্নয়নে এইসব অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন সিআইপি (ব্যবসাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি) মর্যাদা।
চ্যালেঞ্জ নিতে বরারবই পছন্দ করেন ড. মো. সবুর খান। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় দুই হাজার উদ্যোক্তা তৈরির এক মহত্ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন তিনি। এই উদ্দেশ্যে তিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে ‘হ্যান্ডবুক অব এন্ট্রাপ্রেনারশিপ ডেভলপমেন্ট’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এছাড়াও তিনি ‘উদ্যোক্তা উন্নয়ন নির্দেশিকা’, ‘আর্ট অব ইফেক্টিভ লিভিং’ এবং ‘এ জার্নি টুওয়ার্ডস এন্ট্রাপ্রেনারশিপ’ নামে বই লিখেছেন।

‘আর্ট অব লিভিং’ এবং ‘চেঞ্জ টুগেদার’ ধারনার পথিকৃত্ উদ্ভাবক হিসেবে ড. মো. সবুর খান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তরম্নণ প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হতে উদ্বুদ্ধ করতে তাঁর গৃহীত প্রকল্পসমুহ একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ; যা সমগ্র জাতির ইতিবাচক পরিবর্তন ও বৈশ্বিক পরিবর্তনে পথ সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। কফম্যান ফাউন্ডেশন, গ্লোবাল এন্ট্রাপ্রেনারশিপ নেটওয়ার্ক (জিইএন), চাইল্ড অ্যান্ড ইয়ুথ ফাইন্যান্স ইন্টারন্যাশনালের (সিওয়াইএফআই) সঙ্গে সম্পৃক্ততা তাঁকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে খ্যাতি এনে দিয়েছে। ড. মো. সবুর খান তাঁর দীর্ঘ ব্যবসায়িক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে নানা শিক্ষা অর্জন করেছেন যা তাঁকে করিত্কর্মা, প্রত্যুত্পন্ন ও লক্ষ্য অর্জনে সংকল্পবদ্ধ করেছে। ব্যবসা ক্ষেত্রে তাঁর অবদানকে মূল্যায়ন করে বাংলাদেশ সরকার ড. মো. সবুর খানকে সম্মানজনক ‘সিআইপি’ পুরষ্কারে ভূষিত করেছে।
বর্তমানে ড. মো. সবুর খান বিশ্বের ৮০টি দেশের আইসিটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংগঠন ওয়ার্ল্ড ইনফরমেশন টেকনোালজি সার্ভিসেস এলায়েন্স (উইটসা)-এর পরিচালক এবং উইটসার বিশ্ব বাণিজ্য পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। এছাড়া এশিয়ান ইউনিভার্সিটি প্রেসিডেন্ট ফোরাম (এইউপিএফ), ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনিভার্সিটি প্রেসিডেন্টস (আইএইউপি), ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনিভার্সিটিস (আইএইউ), এশিয়ান-ওশেনিয়ান কম্পিউটিং ইন্ডাস্ট্রি অর্গানাইজেশন (এএসওসিআইও), এশিয়া কোঅপারেশন ডায়ালগ (এসিডি) সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরম্নত্বপ–র্ণ ভূমিকা পালন তাঁর ক্যারিয়ারকে করেছে সুবিসত্মৃত।
এত বর্ণিল ক্যারিয়ার যার, তার ঝুলিতে পুরস্কার জুটবে না তাকি হয়? জাতি গঠনে অসামান্য অবদান রাখায় বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে অসংখ্য সম্মানজনক পুরষ্কার লাভ করেছেন ড. মো. সুবর খান। ইতিবাচক লক্ষ্য নিয়ে দেশের সেবা করার ফলশ্রুতিতে এসব অর্জন তাঁর ঝুলিতে ভরতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। ব্যবসা, উদোক্তাবৃত্তি, নেতৃত্ব ও মানব সম্পদ উন্নয়ন খাতে সফলতা ও দক্ষতার কারণে ইন্দোনেশিয়ার ইউনিভার্সিটাস উবুদিয়ান ইন্দোনেশিয়া (ইউইউআই) তাঁকে নিজেদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে। এছাড়া সাইবার ইউনিভার্সিটি অব ইন্দোনেশিয়া তাঁকে নিযুক্ত করেছে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে।
ড. মো. সবুর খান বিভিন্ন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছেন। তিনি উত্তর ফিলিপাইনের প্যানপ্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির ২৩তম সমাবর্তনে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে শিক্ষার্থীদের সামনে বক্তব্য প্রদান করেন।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উদ্যোক্তা তৈরিতে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখায় স্বাপ্নিক নেতা ড. মো. সবুর খান ‘এমটিসি গ্লোবাল আউটস্ট্যান্ডিং কর্পোরেট অ্যাওয়ার্ড-আইসিটি’, ‘ গ্লোবাল অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সিলেন্স ইন কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড লিডারশিপ’, ‘ওয়ার্ল্ড এডুকেশন কংগ্রেস গ্লোবাল অ্যাওয়ার্ড’, ‘এশিয়াস মোস্ট ইন্সপায়ারিং নেশন বিল্ডার অ্যাওয়ার্ড’, ‘সৌন্দর্য বর্ধনে প্রধানমন্ত্রী পদক’, ‘ইউটসা অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট আইসিটি এন্ট্রাপ্রেনার’, ‘বেসিসের লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’, ‘বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির আজীবন সম্মাননা পুরষ্কার’, ‘এইচএসবিসি স্বর্ণ পদক’, ‘সাউথইস্ট ব্যাংকের র্যাপোর্ট ম্যানেজমেন্ট এক্সিলেন্সি অ্যাওয়ার্ড’সহ অসংখ্য পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়াও তিনি ‘এশিয়ার শীর্ষ ১০ ব্যবসায়ী নেতা’র একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
ড. মো. সবুর খানের সুদক্ষ নেতৃত্বে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি উইটসা মেরিট অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছে। তাঁর নিঃস্বার্থ ব্যক্তিত্ব এবং সুনিপুণ নির্দেশনায় অনেকের মাঝে নেতৃত্ব গুণ বিকশিত হচ্ছে যা তার স্বপ্ন ও লড়্গ্য ‘চেঞ্জ টুগেদার’কে বাসত্মবায়ন করছে।
স্বপ্নবাজ এই ব্যবসায়ী চাঁদপুর জেলার বাবুরহাটে ১৯৬৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সাত ভাই বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত্ম চাঁদপুরেই পড়ালেখা করেছেন। পরে ১৯৮৮ সালে স্নাতকোত্তর পাশ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ইচ্ছে ছিল পাইলট হবেন। আকাশে উড়বেন। সে ইচ্ছে অবশ্য শেষাবধি প–রণ হয়নি। তিনি হয়েছেন বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পাইলট। যার আকাশে শুধু সাফল্যের ওড়াউড়ি!