ছোট্ট তূর্যকে হয়তো তোমরা কেউ চিনবে না। তবে ও যেই মজার কাজটা করতে পারে তা বললে তোমরা সবাই ওর সর্ম্পকে জানতে চাইবে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
ওর সর্ম্পকে বলার আগে তোমাদের জিজ্ঞেস করি, ভাস্কর্য (Sculpture) জিনিসটা কী তা কি তোমরা কেউ জানো? যারা জানো না তাদের জন্য সহজ করে বলি, অনেক রাস্তার ধারে অথবা বাড়ি কিম্বা হোটেলের সামনে সিমেন্ট, ইট-সুরকির তৈরি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের প্রতিকৃতি বসানো থাকে। কখনো বিভিন্ন প্রাণীরও প্রতিকৃতিও চোখে পড়ে আমাদের।
যেমন ঢাকার সার্ক ফোয়ারার পাশে রয়েছে সিমেন্টর তৈরি বিশাল একটি বাঘ। আবার বনানীর কাকলীতে রাস্তার পাশে রয়েছে আমাদের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারের প্রতিকৃতি।
এগুলোকেই ভাস্কর্য বলে। জেনে রাখো শিল্পকলারই একটি অংশ বিশেষ। এতোদিন আমরা জানতাম ভাস্কর্য গড়া শুধু বড়দেরই কাজ। আর ছোটরা শুধু সেগুলো দেখবে। কিন্তু তূর্য আমাদের সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছে। ছোটরাও যে ছবি আঁকা, বই পড়া, খেলাধুলা বা দুষ্টামির বাইরেও কিছু করতে পারে তূর্য তাই আমাদের দেখিয়েছে।
তূর্য কি করতে পারে জানো? ও তোমাকে দেখে হুবুহু তোমারই ভাস্কর্য বানিয়ে দিতে পারে। কি অবাক হচ্ছো! খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইচ্ছে শক্তি থাকলে বয়স যে কোন বাধা নয় তাই প্রমাণ করেছে তূর্য।
তূর্যের পুরো নাম পল্লব সিংহ তূর্য। ও যশোর জেলা স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। তূর্যের বাবা পলাশ সিংহ জামা-কাপড় সেলাইয়ের কাজ করেন। মা ঘরের কাজকর্ম সামলান। ওরা দুই ভাইবোন। তূর্যই সবার বড়।
গত বছরের ঘটনা। রাতে তূর্য টেলিভিশন দেখছিল। হঠাৎ একটি চ্যানেলে সে দেখতে পেলো, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ওদের পাশের জেলা নড়াইলে আসছেন। তূর্য সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা দিয়ে প্রণব মুখার্জির ছবি তুলে ফেলল।
তারপর রাতেই ইট-সুরকি, বালি, সিমেন্ট নিয়ে প্রণব মুখার্জির ভাস্কর্য বানানো শুরু করে দিল। রাত ১০টা থেকে রাত ২টা একটানা ৪ ঘণ্টা কাজ করে বানিয়ে ফেলল অবিকল প্রণব মুখার্জির ভাস্কর্য। তূর্যের ইচ্ছা ছিল ভাস্কর্যটি প্রণব মুখার্জিকে উপহার দেবে। ওর সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। প্রবণ মুখার্জি নড়াইল এলে তাকে ভাস্কর্যটি উপহার দেয় তূর্য।
তূর্যের বাসায় যদি কখনো যাও তাহলে দেখবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশাল এক ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্য তৈরিতে সে ব্যবহার করেছে ইট, বালি, সিমেন্ট আর রড। এটা দেখলে মনেই হবে না ছোট্ট তূর্য এতো বড় কাজ করতে পারে।
এছাড়াও তূর্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, স্বামী বিবেকানন্দ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মাদার তেরেসা, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান অনেক ব্যক্তিত্বের ভাস্কর্য গড়েছে ।
এমনকি তূর্যর ভাস্কর্যের লিস্ট থেকে বাদ যায়নি যশোরের খ্যাতনামা ব্যক্তিরাও। এ যাবত তূর্য সব মিলিয়ে প্রায় শ’খানেক ভাস্কর্য তৈরি করেছে।
এখানেই শেষ নয়, তূর্যের বানানো ভাস্কর্য কিন্তু যশোরের বিভিন্ন স্থানেও স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া তূর্যের স্কুলে কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান হলে ওর তৈরি কোন না কোন শিল্পকর্ম স্টেজে শোভা পায়।
তূর্যর বয়স যখন সাত তখন থেকেই নাকি সে ভাস্কর্য বানানোতে ঝুঁকেছে। প্রথম দিকে ও মাটি দিয়ে নানা জিনিস তৈরি করত। কোনো কিছুর ছবি দেখলেই সেটার প্রতিকৃতিও বানিয়ে ফেলত।
ভাস্কর্য বানানোর বিষয়ে তূর্য বলে, ‘আমি অনেক ছোট থেকেই এই কাজ করি।
এ কাজ করতে আমার মজা লাগে। আমার স্কুলে যাওয়া-আসার রাস্তার পাশে একটা দোকান ছিল যারা বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি বানাতো। সেখানে গিয়ে আমি বসে থাকতাম। টেলিভিশনে ভাস্কর্য বানানোর অনুষ্ঠান হলে সেটিও দেখতাম।
এভাবেই আমি দেখে দেখে শিখে ফেলেছি। ইট বালি সিমেন্ট জমিয়ে তা কেটে কেটে আমি ভাস্কর্য বানাই। বানানো শেষে শুকানোর পর আমি তা রঙ করি। তবে ভাস্কর্য তৈরির বালি, সিমেন্ট আর ইট সংগ্রহ করতে আমার অনেক কষ্ট হয়। অবশ্য এসব সংগ্রহে বাবা আমাকে সাহায্য করে। আমি আরো কিছু ভাস্কর্য বানাতে চাই। এখন তো আমার বয়স ১৪, আর একটু বড় হলে আমি পাথর কেটেও ভাস্কর্য বানাবো। সেটি অবশ্য আরো ভাল হবে।’
তূর্য বড় হয়ে নামকরা ভাস্করশিল্পী হতে চায়। তার মা-বাবারও একই ইচ্ছা। তূর্য কিন্তু এখন অবধি অনেক পুরষ্কারও পেয়েছে। যশোরের জেলা প্রশাসকসহ বেশ কয়েকজন তাকে পুরস্কৃতও করেছেন। ছোট্ট তূর্য কিন্তু ভাস্কর্য শিল্পীই নয়, ও ভালো গানও গাইতে পারে। ছবিও আঁকতে পারো তূর্য।
আর হ্যাঁ ভালো কথা, ও কিন্তু পড়াশোনার পাশাপাশিই এসব করে। পড়াশোনায় কিন্তু এতোটুকুও ফাঁকি দেয় না ও। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর অবসর সময়ে এসব কাজ করে তূর্য।
কেমন লাগলো তোমাদের তূর্যর কথা শুনে। তোমারাও যদি পড়াশোনার পাশপাশি এমন কিছু করো তাহলে তা আমাদের অবশ্যই জানাবে। আমরা তোমাদের কথা জানিয়ে দেবো অন্য বন্ধুদের।