বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে জীবন-যুদ্ধে সফল হওয়ার জন্য সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার হলো যোগাযোগ-দক্ষতা। ভালো যোগাযোগ-দক্ষতা ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি স্তরকে সহজ করে তুলে। তাই ইদানীং নিয়োগকর্তা, সফল উদ্যোক্তা, পেশা পরামর্শকদের কথায় বারবার ঘুরে-ফিরে আসে ‘কমিউনিকেশন স্কিল’ বা ‘যোগাযোগ–দক্ষতা’র কথা।
পেশা যাই হোক না কেন, যোগাযোগ-দক্ষতা থাকা আবশ্যক। আর এর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো ছাত্রজীবন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে কীভাবে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরো দক্ষ হয়ে ওঠা যায়, সে বিষয়গুলো দেখে নেওয়া যাক:
১। সব বিষয় সম্পর্কে ধারণা রাখা:
যোগাযোগ দক্ষতা বিকাশের জন্য সবরকমের যোগাযোগেই নিজেকে সাবলীল ও দক্ষ করে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলা ও ইংরেজিতে সাবলীলভাবে বলতে ও লিখতে পারা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কোনোকিছু বুঝে পড়া এবং মন দিয়ে শোনাও খুব জরুরি। আপনি যা বলছেন, তা আরেকজন বুঝতে পারছে কি না তা আপনি নিজে ওই বিষয়টি কতটা ভালোভাবে বোঝেন তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। পাশাপাশি আপনার ভাষার ওপর দখল কিংবা শরীরী ভঙ্গিও আপনার যোগাযোগ দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।
২। জানার পরিধি বাড়ানো:
যারা অনেক পড়েন, তারা অনেক বিষয় সম্পর্কে খোঁজ রাখেন। সরাসরি বই-সাময়িকী-সংবাদপত্র কিংবা ইন্টারনেটে ই-পত্রিকা, ই-সাময়িকী বা পেশা-বিজ্ঞান-ব্যবসা বিষয়ক কোনো পোর্টালই হোক না কেন, নিয়মিত চোখ রাখলে সাম্প্রতিক সব বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
যোগাযোগ–দক্ষতা বিকাশের জন্য যখনই কোনো লেখা পড়া হয় তখনই মাথায় কিছু প্রশ্ন গেঁথে নিতে হবে। যেমন লেখাটি লেখক কেন লিখেছেন, কার জন্য লিখেছেন, কোন পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছেন, কী কী বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, কোন কোন বিষয় যুক্ত করা যেতে পারে, নিজে লিখলে কীভাবে লেখা যেত ইত্যাদি। এতে করে জানার পরিধি আরও বাড়বে এবং সেই বিষয়ে আপনার ধারণা পাকাপোক্ত হবে। এর ফলে কথা বলার সময় আত্মবিশ্বাসও বাড়বে।
৩। প্রয়োজনে কাউকে অনুসরণ করুন:
যোগাযোগ–দক্ষতা বিকাশের জন্য বক্তৃতা তথা নিজের ভাবনা উপস্থাপন করতে জানতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি সহজ উপায় হলো যেকোনো বিখ্যাত ব্যক্তির কৌশলগুলো অনুসরণ করা। ইউটিউবে পৃথিবীখ্যাত ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা আর প্রভাবশালীদের বক্তব্য দেওয়ার কৌশল নিয়ে অনেক ভিডিয়ো দেখতে পারেন আপনি। এছাড়া এই বিষয়ক বইও পড়া যায়। যেমন ক্রিস অ্যান্ডারসনের লেখা টেড টক: দ্য অফিশিয়াল টেড গাইড টু পাবলিক স্পিকিং–এ জাতীয় বইগুলোও পড়তে পারেন। তবে এক্ষেত্রে পড়ার পাশাপাশি তা নিয়মিত প্র্যাকটিস করার কোনো বিকল্প নেই।
৪। কোর্স করা:
অনলাইনে বিভিন্ন কোর্স আছে যোগাযোগ-দক্ষতা বিকাশের জন্য। ব্যাবসা বা কর্মক্ষেত্রে যোগাযোগ, ই-মেইল লেখা, প্রেজেন্টেশন তৈরির মতো কৌশলগুলো কোর্স থেকে শেখার সুযোগ আছে।
যোগাযোগ-দক্ষতা বিকাশের জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমবর্ষে কিছু প্রাথমিক কোর্স করানো হয়। এই কোর্সগুলো অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা মনোযোগসহকারে করে না বা গুরুত্ব প্রকাশ করে না। কিন্তু দেখা যায় যে, পরবর্তী পেশা জীবনে এই দক্ষতাগুলোই অনেক সময় বেশি কাজে লাগে। তাই শিখে নেওয়ার বিকল্প নেই।
৫। চর্চা করা লেখা:
একজন বড়ো খেলোয়াড় জন্ম থেকে বড়ো খেলোয়াড় হয় না, বরং নিয়মিত প্রাকটিস আর সাধনাই তাকে বড়ো খেলোয়াড় হিসেবে একসময় প্রতিষ্ঠিত করে। তেমনি যোগাযোগ-দক্ষতাও প্রতিদিন চর্চার মাধ্যমে বিকশিত হয়। তাই চর্চার দিকে আরও মনোযোগ দিতে হবে। আমরা অনেকেই মনে করি, কথা তো আমরা সবাই-ই ছোটোবেলা থেকেই বলতে পারি–তাই যোগাযোগ দক্ষতার চর্চা করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটা একেবারেই ভুল। যেকোনো দক্ষতাই প্রচুর চর্চা এবং সাধনার ফল–এটা মাথায় রাখতে হবে।
৬। ভুল থেকে শেখা:
যেকোনো কিছুর শুরুর দিকে দুর্বলতা থাকে, ভুল থাকে। বাংলা বা ইংরেজিতে কথা বলা কিংবা প্রেজেন্টেশন দেওয়ার সময় ভুল হওয়া স্বাভাবিক। ভুল থেকেই শিখতে হবে। বিখ্যাত বক্তারা তাদের বক্তব্য শেষে দর্শকদের কাছ থেকে ভুলভ্রান্তি কী ছিল, তা জানার চেষ্টা করেন। ভুল দেখে অন্যরা হাসতে পারে, কটু কথা বলতে পারে—এসব নিয়ে মন খারাপ করলে চলবে না। বরং আপনি একটি ডায়ারিতে যেসব ভুল হচ্ছে, সেগুলো নোট নিন এবং কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করুন। দেখবেন ধীরে ধীরে আপনার ভুল করার পরিমাণ কমছে এবং সাফল্যের হার বাড়ছে।
৭। শরীরী ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ:
যেকোনো যোগাযোগের ক্ষেত্রে শুধু বলে গেলে হবে না। লেখার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কোনো কিছু লেখা বা বলার আগে জানতে হবে, যার উদ্দেশ্যে বলা বা লেখা হচ্ছে, তিনি বুঝতে পারছেন কি না। পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝতে হবে, অন্যের শরীরী ভাষা পড়তে জানতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন দুর্দান্ত একটি আইডিয়া বা ধারণা উপস্থাপন করেছেন। শ্রোতার শরীরী ভাষা থেকেই তাকে বুঝতে হবে, তিনি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন কি না কিংবা বুঝতে পারছেন কি না। মুখের হাসি, চোখে চোখে তাকানো (আই কন্টাক্ট), হাতের অবস্থান কিংবা নড়াচড়া—এসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার শরীরী ভাষাই বলে দেয় আপনি আপনার বক্তব্যে কতটা কনফিডেন্ট। তাই শরীরী ভাষার ওপরে জোর দিন।
৮। নিজেকে জানতে হবে:
নিজের সম্পর্কে জানতে হবে। আমি কেমন, আমার ব্যক্তিত্ব কেমন, কোথায় আমার শক্তি বা দুর্বলতা, আমার যোগ্যতা কী, কোন কোন বিষয়ে আমি দক্ষ এগুলো জানতে হবে। যোগাযোগ-দক্ষতা বৃদ্ধির অন্যতম হাতিয়ার হলো নিজের ব্যক্তিত্ব বিকাশ। ইতিবাচক মনোভাব, যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার কৌশল, নিজের শক্তির জায়গাগুলোকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করার দক্ষতা ব্যক্তিসত্তাকে এগিয়ে রাখে।
৯। পরামর্শ গ্রহণ:
যোগাযোগ-দক্ষতার কৌশল আয়ত্তের জন্য গুণীজনদের পরামর্শ নেওয়া যায়। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের পেশাজীবীর পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন। আপনি যে ক্ষেত্রে পেশা গড়তে চান কিংবা যে বিষয়ে পড়ছেন, তা সম্পর্কে কী কী যোগাযোগ-দক্ষতা প্রয়োজন, তা জানতে পরামর্শ নিতে পারেন। যোগাযোগ-দক্ষতা বিকাশের জন্য কোচ বা মেন্টর নির্বাচন করে তার কাছ থেকে হাতে-কলমে শেখার যেতে পারে। ‘কথা বলা আবার শেখার কী আছে’—এমনটি কখনই ভাবা উচিত নয়।
১০। নেতৃত্ব বিকাশ:
যোগাযোগ-দক্ষতা যেকোনো ক্ষেত্রে নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ করে দেয়। দুঃখজনক হলেও সত্য কোনো দলের নেতা বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক হওয়ার পরও কেউ কেউ যোগাযোগে দক্ষ নন। যোগাযোগ-দক্ষতা বিকাশে সক্ষম যেকোনো ব্যক্তিই যেকোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষানবিশ থেকে কর্মকর্তা হতে পারেন কিংবা দলের সাধারণ সদস্য থেকে চলে যেতে পারেন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নেতৃত্বের জায়গায়।
১১। সুযোগের সদ্ব্যবহার:
কথা বলা, লেখা বা নিজের ভাবনা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে খুব আত্মবিশ্বাসী না হলেও এসবের কোনো সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। বিতর্ক, বিজনেস কেস কম্পিটিশন, রচনা প্রতিযোগিতা, বক্তৃতা এসবে নিজেকে যুক্ত রাখতে হবে। বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
সর্বোপরি নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে। নিজেকেই নিজে বারবার ভেঙে গড়ে তুলতে হবে।
উল্লেখিত বিষয়গুলো চর্চার মাধ্যমে একজন খুব সহজেই তার যোগাযোগের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারবে এবং নিজেকে নতুনরূপে তুলে ধরতে পারবে।