প্রচারণা ডটকম ডেস্ক : বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হলো ‘ডায়ালগ অন ডেটা প্রাইভেসি অ্যান্ড ডেটা প্রোটেকশন’ শীর্ষক অনলাইন সংলাপ।
বাংলাদেশে ডেটা বা তথ্যের কোনো শ্রেণিবিন্যাস নেই এবং এর সুরক্ষার জন্য নেই কোনো সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন। তাই ডেটা প্রাইভেসির গুরুত্ব অনুধাবন করে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি অংশীজনদের নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে এই অনলাইন সংলাপের আয়োজন করা হয়।
গত শনিবার (২২ আগস্ট) অনুষ্ঠেয় সংলাপে ভারতের খ্যাতনামা ল-ফার্ম খাইতান অ্যান্ড কো-এর বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিগণ অংশ নেন। খাইতান ভারতে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষাবলি-২০১৮-এর খসড়া তৈরিতে ভারত সরকারকে পরামর্শ প্রদানের কাজে নিয়োজিত। তারা ডেটা প্রাইভেসি ও প্রোটকেশনের ওপর একটি উপস্থাপনা পেশ করেন। আলোচকগণ তার ভিত্তিতে নিজস্ব মতামত ও পরামর্শ প্রদান করেন।
স্বাগত বক্তব্যে বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে ডেটা প্রাইভেসি ও ডেটা প্রোটেকশন দেশের প্রচলিত তথ্য-অধিকার আইন দ্বারা পুরোপুরি সংরক্ষিত হচ্ছে না। তাই ব্যক্তি-গোপনীয়তার অধিকার রক্ষার্থে তথ্য-গোপনীয়তার অধিকার নিশ্চিত করতে বিরোধপূর্ণ যেকোনো আইন বাতিল ও সংশোধন করতে হবে। একই সাথে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা ও গোপনীয়তা রক্ষার জন্য নতুন আইন ও নীতিমালা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সংগঠন দ্বারা ব্যক্তি-সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্রচার ও প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির সর্বাধিক নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা কীভাবে বজায় থাকবে—তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ডেটা সংরক্ষণ নীতিমালা প্রণয়ন করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজকের সংলাপের আলোকে বেসিস ডেটা প্রাইভেসি ও ডেটা প্রোটেকশন বিষয়ে খসড়া একটি গাইডলাইন প্রস্তুত করে সরকারের সামনে উপস্থাপন করবে।’
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে অংশ নেন খাইতান অ্যান্ড কো’র পার্টনার সুপ্রতীম চক্রবর্তী, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. রোকন-উজ-জামান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও লিগ্যাল কাউন্সিলের পার্টনার মিতি সানজানা, আইনজীবী তানজীব-উল আলম, বাংলাদেশ আইপি ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আইনজীবী এ বি এম হামিদুল মিসবাহ, অ্যাসপ্যায়ার টু ইনোভশেন (এটুআই) প্রোগ্রামের চীফ টেকনোলজি অফিসার মোহাম্মদ আরেফ এলাহী, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (প্রোগ্রামিং) দেবদুলাল রায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের এডিসি মো. নাজমুল ইসলাম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সিস্টেম ম্যানেজার মোহাম্মদ শফিকুর রহমান, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব)-এর সভাপতি মাহতাব উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।
খাইতান অ্যান্ড কো’র পার্টনার সুপ্রতীম চক্রবর্তী ডেটা প্রাইভেসি ও ডেটা প্রোটেকশন বিষয়ে বলেন, ‘অ্যাপ্লিকেশন ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আমরা যে ডেটাগুলো দিচ্ছি, এমনকি ট্রেনে-বাসে পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তায় নিজেদের যেসব তথ্য আদান-প্রদান করছি—তার গোপনীয়তা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। ব্যক্তিগত ও স্পর্শকাতর ডেটা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইন তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। এ-সংক্রান্ত আইন তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোনো প্রতিষ্ঠান যদি ব্যক্তিগত ডেটা সংরক্ষণ করে, কোনো ব্যক্তি চাইলে যেন সেই ডেটা অ্যাক্সেস করতে পারে এবং প্রয়োজনে সংশোধন করতে বা ডিলিট করতে পারে। আর, বাংলাদেশের তথ্য-সংক্রান্ত আইন তৈরি করার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য আইনকে হুবহু অনুকরণ করা যাবে না।’
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. রোকন-উজ-জামান বলেন, ‘এখনো আমাদের দেশে ডেটা প্রাইভেসি নিয়ে কোনো গবেষণা করা হয়নি। ফলে আমরা জানি না বিষয়টা নিয়ে আসলে কীভাবে কাজ করা যেতে পারে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের কোনো আইনি কাঠামো নেই এই বিষয়ে। ভবিষ্যতে কী হবে—তার ওপর ভিত্তি করে এই আইনটি তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত, সরকারি এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে কার কী দায়িত্ব থাকবে—তাও ঠিক করতে হবে।’
আইনজীবী মিতি সানজানা বলেন, ‘ডেটা প্রাইভেসি ও ডেটা প্রোটেকশন নিয়ে ইতিমধ্যে বাংলাদেশে একটি আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের এখনও এই আইন নিয়ে কোনো ধারণা নেই। এই খসড়াতে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রয়েছে ৫ লাখ টাকা ও ৭ বছরের কারাদ-। এ ছাড়া বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে লঙ্ঘিত হতে পারে। যে খসড়া আইনটি আছে, সেটি আরও ভালোভাবে কীভাবে তৈরি করা যায়—আমাদের সেটা নিয়েই কাজ করতে হবে।’
এটুআই প্রোগ্রামের চীফ টেকনোলজি অফিসার মোহাম্মদ আরেফ এলাহী বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারী আমাদের তথ্য-উপাত্তের গুরুত্ব অনুধাবন করতে সহায়তা করেছে। তাই আমাদের এখনই ডেটা গভর্নেন্সের কথা ভাবতে হবে। পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক এবং রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ে আসতে হবে।’ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ডিজিটাল ইকোসিস্টেম তৈরির বিষয়ে জোর দেন তিনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের এডিসি মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাজ করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। আমাদের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০১৮-এর ওপর নির্ভর করেই সব কাজ করতে হয়। তাই সরকার এরকম একটি আইন প্রণয়ন করে দিলে পুলিশ আরও ভালোভাবে জনগণের জন্য কাজ করতে পারবে।’
আইনজীবী এ বি এম হামিদুল মিসবাহ বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০১৮-এর সেকশন-২৬-এ যে তথ্যের কথা বলা হয়েছে—তা ডেটা নয়। বিশ্বের অন্যান্য বিদ্যমান আইনের ওপর ভিত্তি করে আমাদের নিজেদের আইন বিশেষভাবে তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে বেসিস ও আইসিটি বিভাগ একসাথে কাজ করতে পারে। এখানে মেধাসত্ত্বকে যুক্ত করা হবে কি না—সেটা নিয়েও চিন্তা করতে হবে ’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সিস্টেম ম্যানেজার মোহাম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, ‘ডেটা কন্ট্রোলার/ প্রোটেকশন অফিসারের দায়িত্ব কী হবে—তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখার সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে তৈরি করতে হবে।’
আইনজীবী তানজীব-উল আলম বলেন, ‘ডেটা প্রাইভেসি ও ডেটা প্রোটেকশন নিয়ে বিধিমালা তৈরি করা যায়, যদি একটি আইন থাকে। বর্তমানে আমাদের দেশে এ-সংক্রান্ত কোনো আইন নেই। সেকশন-২৬ কোনোভাবইে তথ্যের সুরক্ষা সম্পর্কিত আইন নয়। সরকারকে তথ্যের সুরক্ষা-সম্পর্কিত আইনের ওপর বিল আনতে রাজি করাতে হবে।’
এমটিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘তথ্য এখন মুদ্রার মতো। ব্যাংক এখন বিশাল পরিমাণ তথ্য নিয়ে কাজ করে। ডেটা গভর্নেন্সের জন্য একটি কর্তৃপক্ষ থাকা উচিত। আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ক্লাউড সার্ভার ব্যবহার করা দরকার। এ ছাড়া তথ্য শেয়ার করার উপায় থাকতে হবে, যাতে একজন গ্রাহককে তার তথ্যগুলো একবার দিলেই চলবে।’
অ্যামটব সভাপতি মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদরে প্রথমে লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। সেটি হবে—বাংলাদেশে তথ্যচালিত অর্থনীতি। তথ্য বিধিমালাটিকে প্রগতিশীল হতে হবে, যেন প্রয়োজনে পরিবর্তন করা যায়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (প্রোগ্রামিং) দেবদুলাল রায় বলেন, ‘তথ্য-সংক্রান্ত কোনো আইন না থাকার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও কোনো তথ্যের সুরক্ষা-সংক্রান্ত নীতিমালা দিতে পারছে না। ফলে তথ্যের পুণরাবৃত্তি-সংক্রান্ত সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।’
ডিসিসিআইয়ের সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ‘তথ্য-সংক্রান্ত আইনের সবকিছুরই স্থানীয়করণ ও কেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা থাকবে—যেটি এই আইন নিরীক্ষণ করবে।’
বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বেসিস সদস্যবৃন্দ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। স্যাটেলাইট চ্যানেল আরটিভির অফিসিয়াল ফেইসবুক পেইজ থেকে অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।