ডিসেম্বর। আমাদের বিজয়ের মাস। বাঙালির গৌরবের মাস। পরাধীনতার শেকল ভেঙে মুক্ত হওয়ার মাস। এই বিজয় ছিনিয়ে আনতে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে মুক্তিকামী বাংলার জনগনকে। শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হয়েছে নির্ভীক চিত্তে। স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে অানতে বুকের তাজা রক্তে রাঙাতে হয়েছে মাতৃভূমিকে। বিজয়ের মাসে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের গৌরবগাথার টুকরো কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলাে এ প্রজন্মের পাঠকদের জন্য-
ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিন আহমেদ (বীরউত্তম) ফরিদপুর শহরের চর কমলাপুর গ্রামে ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। মা-বাবা, ছয় ভাই এবং ছয় বোনকে ঘিরে শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ফরিদপুরেই। ১৯৬৭ সালে তিনি ফ্লাইং ক্লাব থেকে নিয়মিতভাবে আকাশে উড়ার জন্য CPL (Commercial Pilot License) পান। প্রশিক্ষণ শেষ করে ১৯৬৮ সালে তিনি পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (পিআইএ)’র একজন বৈমানিক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭২-এ ‘বাংলাদেশ বিমান’ গঠিত হয়। তখন তিনি এই সংস্থায় চলে আসেন। ২০০৭ সালে তিনি এই প্রতিষ্ঠান থেকে অবসর নেন।
…………………………………………………..
১৯৭১-এর ৩ এপ্রিল ভারতের কলকাতায় গিয়ে পৌঁছালাম। যদিও তখন ভারতের সাহায্য পাবো কিনা নিশ্চিত না কিন্তু সে সময় সেটাই যেন একমাত্র গন্তব্যস্থল। আগরতলায় প্রবেশ করার সময় আমার সঙ্গে কিছু সাংবাদিকের দেখা হয়।
তারা আমার ভারতে প্রবেশের সংবাদটি স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশ করে। কাঠমান্ডুর পাকিস্তান দূতাবাস ওই পেপারটি পেয়ে ঢাকায় ইনফরমেশনটি জানায়। ফলে পাক-বাহিনী আমার সম্পর্কে অ্যালার্ট হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে তারা আমার মেজ ভাইকে ঢাকার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। যদিও কোনো তথ্য তারা উদ্ধার করতে পারেনি।
৭ তারিখে আগরতলা পৌঁছানোর পর অন্য বাঙালি বৈমানিকরা নানাভাবে আমাকে সাহায্য করে। আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করলাম। ১০ তারিখ আগরতলায় যখন বাংলাদেশ সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন সেই বৈঠকে উপস্থিত থাকার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়।
আমি কাজ করছিলাম বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে। এসময় আমাদের ছোট ছোট কিছু প্লেন দেয়ার জন্য একটি প্রস্তাব ভারত সরকারকে দিলাম। গেরিলা এয়ার স্কোয়াড ফরমেশনের যে প্রস্তাবটি দিয়েছিলাম সেজন্য আলোচনা করতে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারত সরকার আমাদের দিল্লিতে ডেকে পাঠালো।
ক্যাপ্টেন সাত্তার, ক্যাপ্টেন খালেক ও আমি এই তিনজন পাইলট দিল্লিতে যাই। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ভারতীয় বিমান বাহিনী এবং ভারত সরকারের অন্য প্রতিনিধিরা আমাদের সব কথা শুনে প্রস্তাবটি গ্রহণ করলো। তবে তারা জানালো যে এই প্রস্তাবটি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কাছে আসতে হবে। এরপর আমরা বাংলাদেশ সরকারকে প্রস্তাবটি সম্পর্কে জানালাম।
গ্রুপ ক্যাপ্টেন (পরবর্তীকালে এয়ার ভাইস মার্শাল) একে খন্দকার (বীরউত্তম) তখন ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ। তার এবং আমাদের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রচেষ্টায় অবশেষে ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এ বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠিত হয় নাগাল্যান্ডের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল ডিমাপুরে।
এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত একটি পরিত্যক্ত রানওয়ে ছিল। বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সৈন্যরা জাপান ও বার্মা ফ্রন্টে আক্রমণের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতীয় সীমান্তে বেশ কিছু বিমানবন্দর নির্মাণ করে। ডিমাপুর তাদেরই অন্যতম একটি ছিল।
বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ একে খন্দকার এবং ভারত সরকারের পক্ষে ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল প্রতাপ চন্দ্র লাল। এই সংবাদটি গোপন রাখা হয়েছিল সব ধরনের সংবাদ মাধ্যমের কাছ থেকে।
শুরু হলো বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অগ্রযাত্রা। আমরা ছিলাম সিভিলিয়ান পাইলট। আমাদের কোনো সামরিক বা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই আমাদের সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হলো। সেই দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে আমাদের প্রশিক্ষণটি ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক।
আশঙ্কা থাকতাম যেকোনো মুহূর্তে পাহাড়ের সঙ্গে আমাদের প্লেনের ধাক্কা লাগতে পারে। আকাশে অল্প মেঘ করলেই চারপাশের কিছুই দেখা যেতো না। আমাদের প্রশিক্ষণ হতো রাতের বেলা। কারণ আমাদের রাতের বেলায় খুব নিচু উচ্চতায়, মাত্র দুশ বা আড়াইশ ফিট উচ্চতায় ঢাকায় আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে।
অন্যথায় পাক-বাহিনীর রাডারে আমরা ধরা পড়ে যাবো। যুদ্ধের এই সিদ্ধান্তগুলো খুব বিপজ্জনক ছিল। কারণ নিচু উচ্চতায় এলে যেকোনো বিল্ডিং বা স্থাপনায় বাড়ি লেগে প্লেন দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়া আমাদের কোনো পথ ছিল না।
অক্টোবরের মধ্যে আমরা প্রশিক্ষণ শেষ করি। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সূচনায় আমরা ছিলাম নয়জন পাইলট আর বিমান রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রায় ৬০ জন টেকনিশিয়ান। আমাদের বাংলাদেশের অপারেশন ইনচার্জ ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ (বীরউত্তম)।
পরবর্তীকালে যিনি এয়ার ভাইস মার্শাল হন। আর ভারতীয় বিমান বাহিনীর তিনজন প্রশিক্ষক বৈমানিক ছিলেন। তারা হলেন স্কোয়াডন লিডার সঞ্জয় কুমার চৌধুরী, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সি এন সিংলা ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ঘোষাল। ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী মুক্তিবাহিনীর বিমানসেনাদের এই দলটিকে ‘কিলোফ্লাইট’ বলা হতো।
৩ নভেম্বর ১৯৭১। সিদ্ধান্ত হলো আমরা ঢাকায় ও চট্টগ্রাম দুই জায়গায় আক্রমণ পরিচালনা করবো। এর মধ্য দিয়ে আমরা কনভেনশনাল ওয়ার শুরু করবো। আমরা সবাই প্রস্তুত যুদ্ধ শুরু করতে।
এমন এক সময় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাদেশের শরণার্থী সংক্রান্ত সমস্যাটি নিয়ে তিনি বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয় ভ্রমণে যাবেন। তাই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের এই যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্তটি স্থগিত রাখার জন্য বলা হলো।
আমাদের সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু না করার পেছনে আরো কিছু কারণ ছিল। একটি কারণ হলো আমাদের দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলই জলাভূমি। এখানে ভারতীয় ট্যাংক চলাচলে খুব সমস্যা হবে। তাছাড়া একই সঙ্গে আমাদের মুক্তিবাহিনী তথা সৈন্যদেরও অগ্রসর হতে হবে।
এজন্য শীতকাল ছাড়া এ ধরনের যুদ্ধ শুরু করা সে সময় সম্ভব ছিল না। শীতকালে জলাভূমিগুলো শুকিয়ে যায় বলে চলাচল করা সুবিধাজনক। অন্যদিকে হিমালয় পার্বত্যাঞ্চল বরফাচ্ছন্ন হয়ে যাবে। ফলে এসময় চীন কোনো প্রতি আক্রমণ (ইন্টারফেয়ার) করতে পারবে না।
যুদ্ধ শুরু করতে দেরি করার পেছনে এটাও অন্যতম আরেকটি কারণ ছিল । এর পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা হলো, ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সারা বাংলাদেশে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হবে। আগের মতোই আমাদের পরিকল্পনা হলো ঢাকা ও চট্টগ্রামে এভিয়েশন ফিউল ডাম্প করা। মধ্যরাতে আমরা আক্রমণ পরিচালনা করি।
হেলিকপ্টারে করে সুলতান মাহমুদ ঢাকায় এভিয়েশন ফিউল ডাম্প উড়িয়ে দেন আর চট্টগ্রামে আক্রমণ করেন ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ (বীরউত্তম) এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম (বীরউত্তম) এই দুজন। তারা সবাই সাফল্যের সঙ্গে আক্রমণ পরিচালনা করে ফিরে আসেন।
৬ ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা বাংলাদেশ অংশে থাকা পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পুরো ইউনিটকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে সক্ষম হই। এরপর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কোনো প্লেন বাংলাদেশের আকাশে আর উড়েনি।
এ সময় আমাদের প্রতিটি অপারেশনই ছিল ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। প্রতিটি অপারেশনেই প্রায় ১৫টা থেকে ২০টা বুলেট আঘাত হানতো প্লেনের গায়ে। তখন মনে হতো আমরা হয়তো আর জীবিত ফিরতে পারবো না। এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল সিলেটের উত্তর-পূর্বের দরবাস্ত নামক এলাকায়।
মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বিমান বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বিমানবাহিনীর কেউই বুঝতে পারছিলাম না সিলেট শত্রুমুক্ত হয়েছে কিনা। যেহেতু আমি পিআইএর (পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের) বৈমানিক ছিলাম তাই পুরো সিলেট এলাকাটি আমার পরিচিত ছিল।
এজন্য ৭ ডিসেম্বর কাকডাকা ভোরবেলায় ভারতীয় বিমানবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কর্তৃপক্ষের গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সিংলা (ভারতীয় বৈমানিক) এবং আমি- এই তিনজন সিলেট শত্রুমুক্ত হয়েছে কিনা তা দেখতে সিলেট বিমানবন্দরে অবতরণ করতে যাচ্ছি ঠিক সেই মুহূর্তে পাকবাহিনীর বাঙ্কার থেকে মেশিনগান দিয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। বুলেটগুলো আমাদের প্লেনে আঘাত করছিল।
টিনের চালে বৃষ্টি পড়লে যেমন শব্দ হয় বুলেটগুলো প্লেনে আঘাত করায় তেমন শব্দ হচ্ছিল। প্রত্যুত্তরে ওদের ওপর আমরা রকেট আক্রমণ করে নিরাপদে ফিরে আসতে পারি। আমাদের বিমানে অনেকগুলো বুলেট আঘাত করলেও আমাদের শরীরে লাগেনি। আরো যেসব অপারেশন চালিয়েছি তার মধ্যে ছিল বাংলাদেশের সিলেটসহ বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত পাকিস্তান আর্মির হেডকোয়ার্টারের ওপর আক্রমণ, কনভয়ের ওপর আক্রমণ।
এই আক্রমণগুলো সফল হওয়ার কারণে পাকিস্তানিরা দ্রুত পিছু হটছিল এবং ঢাকার দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল, মেঘনার পূর্ব তীরে আমাদের অবস্থান দৃঢ় হয়। বাংলাদেশের এই পর্যন্ত অংশ সম্পূর্ণ আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কিন্তু সেদিনই একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়।
আমরা খবর পাই, প্লেনে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়ায় ভারতীয় বিমানবাহিনীর একজন পাইলট প্লেন থেকে প্যারাসুট দিয়ে ঢাকাতে লাফিয়ে পড়েছেন। সেই পাইলটকে উদ্ধার করে আনার জন্য আমাকে ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সিংলাকে নির্দেশ দেয়া হয়।
আমরা তাকে উদ্ধার করে আনার জন্য জিঞ্জিরা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। কিন্তু তাকে খুঁজে পাইনি। পরে জেনেছি রাজাকাররা তাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে। খবরটা আমাকে খুব মর্মাহত করেছিল।
১১ ডিসেম্বর সিদ্ধান্ত হলো হেলিকপ্টারে করে নরসিংদীর দক্ষিণে আমাদের সৈন্য নামানো হবে। এরপর আমরা ঢাকার দিকে অগ্রসর হবো। সেই মোতাবেক হেলিকপ্টার থেকে সৈন্য নামানো হচ্ছিল। সেই সৈন্যদের ওপর পাকিস্তান বাহিনী অ্যামবুশ করলে আমরা যাতে তা প্রতিহত করতে পারি সেজন্য ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম আর আমি আর্মড স্কোয়াডের দায়িত্বে ছিলাম। দেখলাম আমাদের অনুমানই ঠিক।
আমাদের এই হেলিকপ্টার অপারেশনে অ্যাটাক করার জন্য পাক সৈন্যরা একটি বাসে করে এগুচ্ছে। তৎক্ষণাৎ আমরা ক্ষিপ্রগতিতে তাদের ওপর রকেট অ্যাটাক করে সম্পূর্ণ বাসটি উড়িয়ে দেই। আমাদের প্লেনে ১৪টি রকেট ছিল। সবগুলো রকেটই ওদের দিকে নিক্ষেপ করি।
পরে এই অপারেশন সম্পর্কে পাক আর্মি তাদের ঢাকার হেডকোয়ার্টারে যে সংবাদ পাঠায় সেটা ইন্টারসেপ্ট করে আমরা জানতে পারলাম যে ওদের প্রায় ২০ জন সেনা নিহত হয়েছে। ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ নরসিংদী মুক্ত হয়।
সূত্র : '৭১ বীরত্ব বীরগাথা বিজয়'- বইয়ের প্রথম খণ্ড থেকে সংগৃহীত