শিশু এবং তরুণদের অনলাইনে মানসম্পন্ন ডিজিটাল শিক্ষা গ্রহণ এবং অনলাইনে বিদ্যমান বিভিন্ন সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে বর্তমানে ডিজিটাল বিভাজন যে বাধা তৈরি করেছে তা দূর করতে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) এবং ইউনিসেফ জরুরি বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে। ইউনিসেফ এবং আইটিইউ এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী স্কুল-বয়সী শিশুদের দুই-তৃতীয়াংশ বা ৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী ১৩০ কোটি শিশুর বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ নেই। ৮৫টিরও বেশি দেশের তথ্য নিয়ে তৈরি করা এই প্রতিবেদনে ০-২৫ বছর বয়সী এবং তরুণ রয়েছে এমন পরিবারগুলোতে ইন্টারনেট সংযোগের প্রাপ্যতা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী প্রতিনিধিত্বকারী বিশ্লেষন ব্যবহার করা হয়েছে।
কত সংখ্যক শিশু ও তরুণের ঘরে ইন্টারনেট সুবিধা আছে? শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী স্কুল-বয়সী শিশুদের দুই-তৃতীয়াংশের বাড়িতে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ নেই। একই অবস্থা ১৫-২৪ বছর বয়সী তরুণদেরও। তরুণ জনগোষ্ঠীর ৬৩ শতাংশ বা ৭৫ কোটি ৯০ লাখ তরুণ-তরুণীর ঘরে ইন্টারনেট সংযোগ নেই।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর করা মাল্টি ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৬২ শতাংশ পরিবারের বাড়িতে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ নেই। একইসঙ্গে এটি একটি জাতীয় গড় এবং পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে দরিদ্র ২০ শতাংশ পরিবারের মাত্র ৮ দশমিক ৭ শতাংশের বাড়িতে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে, যেখানে সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ পরিবারের ক্ষেত্রে এই হার ৭৫ দশমিক ৩ শতাংশ। দূরশিক্ষণের আরেকটি প্রধান মাধ্যম টেলিভিশনের বেলায়, জাতীয়ভাবে ৫১ শতাংশ পরিবার টেলিভিশনের মালিক। একইসঙ্গে, সবচেয়ে দরিদ্র ২০ শতাংশ পরিবারের মাত্র ৪ দশমিক ৮ শতাংশ টেলিভিশনের মালিক, যেখানে সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ পরিবারের মাঝে এই হার ৯০ দশমিক ২ শতাংশ।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি টোমো হোযুমি বলেন, দূরশিক্ষণের এই মাধ্যমগুলো ব্যবহারের সুযোগ না পাওয়া শিশুরা ডিজিটাল বিভাজন ও বৈষম্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মহামারি চলাকালীন তারা শিক্ষা গ্রহণের কম সুযোগ পেয়েছে, যা তাদের শিক্ষাজীবন এবং ভবিষ্যতকে এলোমেলো করে দিয়েছে। এই বিভাজন আগে থেকে বিদ্যমান বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এটি দারিদ্র্য ও বৈষম্যের দুষ্ট চক্রকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে পারে, যেখানে শিশুরা পরিণত হচ্ছে এর বাহকে।
কোভিড-১৯ এর কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইন্টারনেট ও টেলিভিশন ছাড়া শিক্ষা কার্যক্রম কার্যকরভাবে এই শিশুদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এমনকি মহামারির আগেও একবিংশ শতাব্দীর অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার জন্য তরুণ জনগোষ্ঠীর একটি ক্রমবর্ধমান অংশের ভিত্তিগত, স্থানান্তরযোগ্য, ডিজিটাল, চাকরি-কেন্দ্রিক এবং উদ্যোগী দক্ষতা শেখার প্রয়োজন হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ডিজিটাল বিভাজন বৈষম্যকে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিচ্ছে, যা ইতোমধ্যে দেশ ও কমিউনিটিগুলোকে বিভক্ত করে ফেলেছে। দরিদ্রতম পরিবার, গ্রামাঞ্চল ও স্বল্প আয়ের পরিবারের শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠী তাদের সমবয়সী বা সহপাঠীদের চেয়ে আরও পিছিয়ে পড়ছে এবং পুনরায় সহপাঠীদের সঙ্গে একই কাতারে পৌঁছানোর সুযোগও তাদের খুব কম।
বিশ্বব্যাপী, সবচেয়ে ধনী পরিবারের স্কুল-বয়সী শিশুদের মধ্যে ৫৮ শতাংশের বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে, যেখানে সবেচেয়ে দরিদ্র পরিবারের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ১৬ শতাংশ। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আয়ের ভিত্তিতে একই ধরনের বৈষম্য বিদ্যমান। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে স্কুল-বয়সী প্রতি ২০ জন শিশুর মধ্যে একজনেরও কম শিশুর বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে, যেখানে উচ্চ-আয়ের দেশগুলোতে প্রতি ১০ জন শিশুর ৯ জনের বাড়িতেই ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে।
দেশ এবং অঞ্চল জুড়ে ভৌগোলিক বৈষম্যও রয়েছে। বিশ্বব্যাপী, শহরাঞ্চলে স্কুল-বয়সী শিশুদের প্রায় ৬০ শতাংশের বাড়িতে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ নেই, যেখানে গ্রামে থাকা পরিবারগুলোর স্কুল-বয়সী শিশুদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ এ সুবিধা পায় না। সাব-সাহারা আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার স্কুল-বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, যেখানে প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে প্রায় ৯ জনই ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে।
বাড়িতে ইন্টারনেট না থাকা ৩-১৭ বছরের স্কুল-বয়সী শিশুর সংখ্যা: পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকায়৯৫% ১৯ কোটি ৪০ লাখ; পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলীয় আফ্রিকায় ৮৮% ১৯ কোটি ১০ লাখ; দক্ষিণ এশিয়ায় ৮৮% ৪৪ কোটি ৯০ লাখ; মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় ৭৫% ৮ কোটি ৯০ লাখ; লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় ৭৫% ৮ কোটি ৯০ লাখ; পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় ৪২% ৩ কোটি ৬০ লাখ এবং পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয়তে ৩২% ১৮ কোটি ৩০ লাখ। বিশ্বব্যাপী ৬৭% ১৩০ কোটি।
গত বছর ইউনিসেফ ও আইটিইউ প্রতিটি স্কুল ও তার আশেপাশের কমিউনিটিকে ইন্টারনেটে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে বৈশ্বিক উদ্যোগ `গিগা’ চালু করে। সরকারগুলোর সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে গিগা এরইমধ্যে ৩০টি দেশে ৮ লাখেরও বেশি স্কুলের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এই তথ্য নিয়ে গিগা ডিজিটাল শিক্ষা সমাধান এবং অন্যান্য সেবাসমূহ স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সংযোগের অবকাঠামো তৈরিতে সরকারি-বেসরকারি মিশ্রিত বিনিয়োগের জন্য বাধ্যতামূলক বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরির লক্ষ্যে সরকার, শিল্প খাত, বেসামরিক খাত এবং ব্যক্তিগত খাতের অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে।
আইটিইউ ও ইউনিসেফ কর্তৃক ২০১৯ সালে চালু হওয়া `গিগা’ প্রতিটি স্কুলকে ইন্টারনেট এবং তরুণ জনগোষ্ঠীর প্রতিটি সদস্যকে তথ্য, সুযোগ ও পছন্দের সঙ্গে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ। এর লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিটি শিশু তাদের প্রয়োজনীয় ডিজিটাল পাবলিক পণ্য দিয়ে সজ্জিত এবং নিজেদের ভবিষ্যত পছন্দ অনুযায়ী সাজাতে ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। আরও তথ্যের জন্য ভিজিট করুন: www.gigaconnect.org
এই উদ্যোগ এখন জেনারেশন আনলিমিটেডের সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে রিইমাজিন এডুকেশন উদ্যোগের অধীনে চলছে। রিইমাজিন এডুকেশন উদ্যোগের মাধ্যমে ইউনিসেফের লক্ষ্য হচ্ছে- শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠীকে মানসম্পন্ন ডিজিটাল শিক্ষা গ্রহণের সমান সুযোগ প্রদান করে শিক্ষার সংকট মোকাবিলা করা এবং শিক্ষাকে রূপান্তর করা। আর এটি অর্জনের মূল চাবিকাঠি হলো সর্বজনীন ইন্টারনেট সংযোগ। এই প্রচেষ্টার ওপর ভিত্তি করে এবং তরুণ জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে তাদের ডিজিটাল দুনিয়ায় সম্পৃক্ত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তরুণদের সক্ষমতা তৈরির লক্ষ্যে জেনারেশন কানেক্ট নামে একটি উদ্যোগ চালু করেছে আইটিইউ।
জেনারেশন আনলিমিটেড (জিইএনইউ) হচ্ছে ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য নজিরবিহীন মাত্রায় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণের জন্য জরুরি প্রয়োজন মেটাতে একটি বৈশ্বিক বহু-পক্ষীয় অংশীদারিত্ব। ভিজিট করুন: www.generationunlimited.org
ইউনিসেফ-আইটিইউ’র প্রতিবেদনে উল্লেখিত সংখ্যাগুলো উদ্বেগজনক চিত্রই তুলে ধরে এবং সহজলভ্যতা, নিরাপত্তা এবং নিম্ন পর্যায়ের ডিজিটাল দক্ষতার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। আইটিইউর সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, নিম্ন পর্যায়ের ডিজিটাল দক্ষতা ডিজিটাল সমাজে অর্থবহ অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে রয়ে গেছে। এর পাশাপাশি যেখানে ক্রয়ক্ষমতায় ব্যাপক বৈষম্যের কারণে উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেকের কাছে মোবাইল টেলিফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার বেশ ব্যয়বহুল হিসেবেই রয়ে গেছে।
এমনকি শিশুদের ঘরে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেও তারা গৃহস্থালি কাজ বা ঘরের নানা কাজের চাপের কারণে, পরিবারে পর্যাপ্ত ডিভাইস না থাকার কারণে, মেয়েদের ক্ষেত্রে কম বা একেবারেই ইন্টারনেট ব্যবহারের অনুমতি না থাকার কারণে অথবা অনলাইনে সুযোগগুলো কীভাবে কাজে লাগাতে হয় সে সম্পর্কি সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে তারা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায় না। এ ছাড়া অনলাইনে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ও রয়েছে, কেননা সন্তানদের অনলাইনে নিরাপদ রাখতে বাবা-মায়েদের যথাযথ প্রস্তুতি নাও থাকতে পারে।