ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনকে কি চিনো তোমরা? নাম নিশ্চয়ই শুনেছাে। অাজ সারাদিন সবগুলো প্রতিটি টিভি চ্যানেলের সংবাদ এবং স্ক্রলে তার মৃত্যু সংবাদ নিশ্চয়ই তোমাদের চোখ এড়িয়ে যায়নি। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। তোমাদের নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করেছ কেনো এই মানুষটি আমাদের সবার কাছে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ? চলো জেনে নেয়া যাক, সবার ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন সর্ম্পকে।
আব্দুল মতিনের জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের চৌহালি উপজেলার ধুবালীয়া গ্রামে। বাবার নাম আব্দুল জলিল এবং মায়ের নাম আমেনা খাতুন। তিনি ছিলেন এই দম্পতির প্রথম সন্তান। তার ডাক নাম ছিল গেদু। ১৯৩০ সালে তাদের বাড়ি যমুনা নদীর ভাঙনে ভেঙ্গে গেলে আব্দুল মতিনের পরিবার ভারতের দার্জিলিং এ চলে আসে। ১৯৩২ সালে তিনি দার্জিলিং-এর একটি স্কুলের ভর্তি হন। ১৯৩৩ সালে মাত্র ৮ বছর বয়সে তার মা মারা যান। ১৯৪৩ সালে দার্জিলিং গভর্মেন্ট হাই স্কুল থেকে এনট্রেন্স (মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা) পরীক্ষায় ৩য় বিভাগ নিয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপর ১৯৪৩ সালে রাজশাহী গভর্মেন্ট কলেজে ভর্তি হন মতিন। ২ বছর পর ১৯৪৫ সালে তিনি এইচ এস সি পাশ করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে আব্দুল মতিন বৃটিশ আর্মির কমিশন র্যাঙ্কে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন এবং ফোর্ট উইলিয়াম থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কমিশন পান। তবে ততোদিনে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটায় তিনি পুনরায় দেশে ফিরে আসেন। দেশে আসার পর মতিন ১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্টস (পাশ কোর্স) এ ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে গ্র্যাজুয়েশন কোর্স শেষ করেন। পরবির্ততে মাস্টার্স করেন আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিভাগ থেকে।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন সোচ্চার করে তোলার পেছনে আব্দুল মতিনের অবদান অন্যতম। ১৯৫২ সালে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে ভাষার দাবিতে আন্দোলনের নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন আবদুল মতিন। তারই নেতৃত্বে একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনের নানা কর্মসূচি সংগঠিত হয়।
১৯৫২ সালে আব্দুল মতিনসহ অন্যরা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। ভাষা আন্দোলনের পর তিনি ছাত্র ইউনিয়ন গঠনে ভূমিকা রাখেন এবং পরে সংগঠনটির সভাপতি হন। এরপর কমিউনিস্ট আন্দোলনে সক্রিয় হন। ১৯৫৪ সালে পাবনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক হন আব্দুল মতিন। মওলানা ভাসানী ‘ন্যাপ’ গঠন করলে তিনি ১৯৫৭ সালে তাতে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল ) গঠন করেন।
চীনকে অনুসরণকারী বামপন্থি দলগুলোর নানা বিভাজনের মধ্যেও আবদুল মতিন সক্রিয় ছিলেন রাজনীতিতে। ১৯৯২ সালে তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ২০০৬ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে ২০০৯ সালে হায়দার আকবর খান রনোর নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টি (পুনর্গঠন) গঠিত হলে আবদুল মতিন তাদের সঙ্গে যোগ দেন।
ভাষা আন্দোলন বিষয়ে তার রচিত বিভিন্ন বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘বাঙালী জাতির উৎস সন্ধান ও ভাষা আন্দোলন’, ‘ভাষা আন্দোলন কী এবং কেন’ এবং ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘জীবন পথের বাঁকে বাঁকে’। ২০১১ সালে তাকে সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা (বেসামরিক) একুশে পদক দেয়া হয়।
অষ্টাশি বছর বয়েসী আব্দুল মতিন তার সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশ মানুষের কল্যানে। মৃত্যুও তাকে থামাতে পারেনি মানুষের কল্যান কামনা থেকে। আব্দুল মতিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই নিজের দেহ দান করে গেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার জন্য। আর চোখ দান করে গেছেন সন্ধানীকে (২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর সকাল ৯টায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান )। গুণী মানুষ সাদা মনের মানুষ ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনকে জানাই আমরা বিনম্র শ্রদ্ধা।