সত্যজিৎ রায়কে চেনে না এমন মানুষ এ দেশে খুঁজে পাওয়াটা একটু দুঃসাধ্যই বটে। চলচ্চিত্র নির্মাণ আর কিশোরদের নিয়ে লেখালেখির সুবাদে বড়োরা তো বটেই একেবারে ছোটদের কাছেও তিনি খুব পরিচিত মানুষ। একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিশু সাহিত্যিক এবং অাঁকিয়ে সত্যজিৎকে নিয়ে তাই কৌতুহলের শেষ নেই। তোমরা যারা তার লেখা পড়েছো বা তার বানানো সিনেমা দেখেছো অথচ তার সর্ম্পকে খুব বেশি কিছু জানো না তাদের জন্যই এই লেখা।
সত্যজিৎ রায়ের জন্ম ১৯২১ সালের ২ মে কলকাতায়। সত্যজিৎ-এর জন্ম পশ্চিমবঙ্গে হলেও তার পূর্বপুরুষের ভিটাবাড়ি কিন্তু ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে। বর্তমানে তাদের প্রায় ৪ একরের এই বিশাল জমি ও বাড়ি বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব বিভাগের অধীনে রয়েছে।
এছাড়া সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ হরি কিশোর রায় চৌধুরী প্রায় ২০০ বছর আগে মসূয়া গ্রামে কালভৈরব পূজা উপলক্ষ্যে একটি মেলার আয়োজন করেছিলেন। এখনও প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ বুধবার এই মেলা বসে।
সত্যজিৎ-এর পরিবারকে এক বাক্যে সাহিত্যিক পরিবার বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। তার বাবা সুকুমার রায় এবং দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী দুজনেই বাংলা শিশু সাহিত্যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। সুকুমার রায় ছিলেন একাধারে লেখক, সম্পাদক ও আলোকচিত্রী। এছাড়া তিনি "Royal Photographic Society of Great Britain" এর ফেলো ছিলেন।
সত্যজিৎ এর দাদা অর্থাৎ সুকুমার রায়ের বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন শিশুসাহিত্যিক, চিত্রকর, আলোকচিত্রী, ব্লক ডিজাইনার এবং শিশুতোষ পত্রিকা "সন্দেশ" এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। বেহালা বাদক হিসেবেও তার যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। তিনি ভারতের অন্যতম সেরা প্রেস "U. Ray & Sons" এর প্রতিষ্ঠাতা। সত্যজিৎ-এর জন্মের ৬ বছর আগেই তিনি মারা যান। সত্যজিৎ রায় মা সুপ্রভা দেবী ছিলেন সংগীত শিল্পী। বলে রাখা ভালো সত্যজিৎ তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন।
সত্যজৎি-এর জন্মের দুই বছর পর অর্থ্যাৎ ১৯২৩ সালে তার বাবা সুকুমার রায় মারা যান। এর পরই তাদের পারিবারিক প্রিন্টিং ব্যবসাটি তাদের হাত ছাড়া হয়ে যায়। এ সময় সত্যজিৎ-এর পরিবারকে আর্থিক অনটনে পড়তে হয়। এক পর্যায়ে সত্যজিৎ তার মায়ের হাত ধরে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে মামা বাড়িতে চলে যান। ৮ বছর বয়সে বালিগঞ্জ সরকারি স্কুলে ভর্তি হন তিনি। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই চলচ্চিত্র ও ওয়েস্টার্ণ ক্লাসকি মিউজিকের প্রতি আগ্রহী ছিলেন সত্যজিৎ। সে সময় থেকেই নামকরা বিদেশী ম্যাগাজিন পড়ার ভীষন ঝোঁক ছিলো তার। মেট্রিকুলেশন শেষে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন তিনি। ১৯৩৯ সালে সত্যজিৎ অর্থনীতিতে গ্রাজুয়েট করেন।
কলেজ পড়ার সময়েও প্রচুর সিনেমা দেখা এবং গ্রামোফোনে গান শোনার কাজটি তিনি সমান তালে চালিয়ে যান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলওে সত্যজিৎ-এর অাঁকার হাত ছিলো অসাধারণ। গ্রাজুয়েশন শেষে তিনি চাকরি করতে চাইলেও তার মা সুপ্রভা দেবী পীড়াপীড়ি করতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রশিল্প বিষয়ে ভর্তি হবার জন্য।
রথমে রাজী না হলেও এক সময় মায়ের অনুরোধ মেনে নেন। নিয়মানুযায়ী বিশ্বভারতীতে সত্যজিৎ-এর সেখানে পাঁচ বছর পড়াশোনা করার কথা থাকলেও তার আগেই ১৯৪৩ সালে তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডি জে কিমারে মাত্র ৮০ টাকা বেতনে “জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার” হিসেবে যোগ দেন। উল্লেখ্য পরবর্তী ১৩ বছর তিনি এই প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেন। ১৯৪৩ সালের দিকে সত্যজিৎ ডি কে গুপ্তের প্রকাশনা সংস্থা 'সিগনেট প্রেস'-এর সঙ্গে জড়িত হন। ডি কে গুপ্ত তাকে সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত বইগুলোর প্রচ্ছদ আঁকার অনুরোধ করেন। এখানে সত্যজিৎ প্রচুর বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করেন। যার মধ্যে জিম করবেটের ম্যানইটার্স অব কুমায়ুন ও জওহরলাল নেহেরুর দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া তিনি বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা কালজয়ী বাংলা উপন্যাস পথের পাঁচালীর একটি শিশুতোষ সংস্করণ আম আঁটির ভেঁপু নিয়েও কাজ করেন। বিভুতিভূষণের লেখা এ উপন্যাসটি সত্যজিৎকে এতোটাই প্রভাবিত করে যে,পরবর্তীতে তিনি তার প্রথম চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হিসেবে এটিকে নির্বাচন করেন। বইটির প্রচ্ছদ আঁকা ছাড়াও তিনি এর ভেতরের বিভিন্ন ছবিগুলোও এঁকে দেন।
সত্যজৎি সবসময়ই চলচ্চিত্রের প্রতি ভীষন আগ্রহী ছিলেন। বিদেশী চলচ্চিত্র ছিলো তার আগ্রহের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ চিদানন্দ দাসগুপ্ত ও অন্যান্যদের সাথে মিলে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। সোসাইটির সদস্য হবার সুবাদে তার অনেক বিদেশী চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ হয়। ১৯৪৯ সালে তিনি তার দূরসম্পর্কের বোন ও বান্ধবী বিজয়া দাসকে বিয়ে করেন। সত্যজিৎ দম্পতির ঘরে ছেলে সন্দীপ রায়ের জন্ম হয়, যিনি নিজেও বর্তমানে একজন প্রথিতযশা চলচ্চিত্র পরিচালক।
সত্যজিৎ রায় সুদীর্ঘ ৩৭ বছর একটানা চলচ্চিত্র নির্মান করেন। ১৯৪৯ সালে বিশ্ববিখ্যাত ফরাসী পরিচালক জ্যঁ রেঁনোয়া "দ্য রিভার" ছবির শুটিং করতে কলকাতায় আসেন। এ সময় সত্যজিৎ তাকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলোতে সিনেমাটির স্পট নির্বাচনে বিশেষ সহায়তা করেন। জ্যঁ রেঁনোয়ার সঙ্গে কাজের এই সুযোগ সত্যজিৎ-এর পরিচালক হয়ে ওঠার পেছনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলো। এছাড়া ১৯৫০ সালে ডি জে কিমার সত্যজিৎকে লন্ডনে তাদের প্রধান কার্যালয়ে কাজ করতে পাঠায়। লন্ডনে মাত্র ৫ মাস ছিলেন তিনি। লণ্ডনেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা লিন্ডসে এন্ডারসন, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ পেনেলোপি হাষ্টন ও গ্যাবিন ল্যাম্বটির সাথে।
বিশ্ববিখ্যাত ইতালিয়ান পরিচালক ভিত্তোরিও ডি সিকা নির্মিত নিওরিয়্যালিস্ট চলচ্চিত্র "লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে"(১৯৪৮) দেখে সত্যজিৎ বিশেষভাবে মুগ্ধ হন। পরে এক সাক্ষাতকারে সত্যজিৎ বলেছিলেন, ছবিটি দেখে সিনেমা হল থেকে বের হওয়ার সময়েই তিনি ঠিক করেন যে তিনি একজন চলচ্চিত্রকার হবেন। শুধু চলচ্চিত্র নয় বাংলা ভাষায় শিশু-কিশোর সাহিত্য রচনাতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। বোদ্ধা মহলে একজন সুনিপুণ চলচ্চিত্রকার হিসেবে তার যে সুখ্যাতি, বই পুড়য়াদের কাছে লেখক হিসেবেও ঠিক একই রকম জনপ্রিয় ও সমাদৃত তিনি।
তার দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর চালু করা "সন্দেশ" পত্রিকার জন্যই মূলত তিনি লিখতেন। এখানে প্রকাশিত লেখাগুলোই মূলত পরবর্তীতে বই আকারে বের হয়েছে। তারা দাদা ও বাবা মারা যাবার পর "সন্দেশ"পত্রিকাটি একসময় বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় এটি আবারো চালু করেন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা গোয়েন্দা চরিত্র "ফেলুদা" এবং বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর ক্ষাপাটে বৈজ্ঞানিক "প্রফেসর শঙ্কু" তার সৃষ্ট অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র।
এছাড়া তিনি অনেক ছোটগল্পও লিখেছেন। তার লেখা বইগুলোর প্রচ্ছদ এবং ভিতরের সব ছবি তার নিজের আঁকা। এছাড়া চলচ্চিত্র নির্মান এবং শুটিং নিয়েও তিনি লিখেছেন বেশ কিছু বই। বইগুলো হচ্ছে, "আওয়ার ফিল্মস, দেয়ার ফিল্মস", "বিষয়: চলচ্চিত্র", "একেই বলে শুটিং" ইত্যাদি। নিজের ছেলেবেলা নিয়ে তার স্মৃতিচারণমূলক বই "যখন ছোট ছিলাম"। এছাড়াও সত্যজিৎ ‘‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’’ নামে একটি ননসেন্স ছড়ার বই লেখেন, যেখানে লুইস ক্যারলের ‘‘জ্যাবারওয়কি’’-র একটি অনুবাদ রয়েছে। তিনি মোল্লা নাসিরুদ্দিনের বিভিন্ন কাহিনী নিয়েও একটি হাসির বই লেখেন।
গুণী মানুষ সত্যজিৎ রায় জীবনে এতো পুরস্কার পেয়েছেন সেগুলোর নাম বলতে গেলে পুরো একটি রাত পেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার পাওয়া মহা গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারগুলো হচ্ছে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষন, ম্যাগাসেসে পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার, অস্কার(Oscar for Lifetime Achievement), ভারতরত্ন।
দীর্ঘদিন হাসপাতালের বিছানায় অসুস্থ অবস্থায় কাটানোর পর ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল এই গুণী মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে।
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চলচ্চিত্র :
পথের পাঁচালী, অপরাজিত, পরশ পাথর, জলসা ঘর, অপুর সংসার, দেবী, তিন কন্যা, পোষ্টমাস্টার, মনিহারা, সমাপ্তি, কাঞ্চনজংঘা, অভিযান, মহানগর, চারুলতা, কাপুরুষ ও মহাপুরুষ, নায়ক, চিড়িয়াখানা, গুপি গাইন বাঘা বাইন, অরণ্যের দিন রাত্রি, প্রতিদ্বন্দী, সীমাবদ্ধ, সিকিম, অশনি সংকেত, সোনার কেল্লা, জন অরণ্য, বালা, শতরঞ্জ কি খিলাড়ী, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরক রাজার দেশে, পিকু, ঘরে বাইরে, গণ শত্রু, শাখা প্রশাখা, আগন্তুক। এগুলো ছাড়া সত্যজিৎ রায় বেশকিছু গুরুত্তপূর্ণ প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করেছেন।