স্বাধীনতার মহান স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি (বিসিএস) অনলাইনে একটি স্মরণ সভার আয়োজন করে। স্মরণসভায় আলোচকরা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে নিজেদের স্মৃতিচারণ করেন।
১৬ আগষ্ট (রবিবার) এই স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিসিএস সভাপতি মো. শাহিদ-উল-মুনীরের সঞ্চালনায় এই স্মরণ সভা পরিচালিত হয়। সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, শেখ রাসেলের গৃহ শিক্ষিকা অধ্যাপক গীতালি দাশগুপ্তা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান এবং বিসিএসের উপদেষ্টা মোজাম্মেল বাবু স্মৃতিচারণ করেন।
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বঙ্গবন্ধুর তুলনা শুধু ‘বঙ্গবন্ধু’। সাংবাদিকদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। একবার তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। তখন কুড়িগ্রাম থেকে একটি ফোন আসে। সাথে সাথে তিনি তার সহকারীকে গাজী গোলাম মোস্তফাকে ফোনে সংযুক্ত করে বলেন, কুড়িগ্রামে আমার মানুষ মারা গেছে। তুমি ত্রাণের ব্যবস্থা করো এবং খোঁজ খবর নাও। তাঁর চেহারায় ব্যথিত ভাব বিরাজ করছিল। মনে হচ্ছিল, তাঁর পরিবারের কেউ হয়তো মারা গিয়েছেন। তিনি এমনি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্বশাসন চালু হয়। শিক্ষকদের পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে তখন অনেকে আপত্তি করেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, শিক্ষকরা তাঁদের বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়। এ থেকেই বুঝা যায় শিক্ষকদের তিনি কতটা শ্রদ্ধা করতেন। তিনি আরও বলেন, ৫২’র ভাষা আন্দোলনে তিনি সাড়ে তিন থেকে চার কোটি মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ৭১ এ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তির পয়গাম দিয়েছেন। আজ ২০ কোটি মানুষ বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করছে। ২০২৫ এ গিয়ে এই সংখ্যা ২৫ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
অধ্যাপক গীতালি দাশগুপ্তা বলেন, শেখ রাসেলকে পড়ানোর প্রস্তাব যখন পেয়েছিলাম তখন সময়ের অভাবে ভেবেছিলাম এই টিউশনিটা আমার করানো হবে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী যখন আমাকে বললেন, শেখ রাসেলের জন্য কি আধা ঘণ্টা সময় বের করা যায় না? না হলে ২০ মিনিট? একেবারে না পারলে ১৫ মিনিট? তখন আমি আর প্রত্যাখ্যান করতে পারিনি। তখনো আমি বুঝতে পারিনি আমি কাকে পড়ানোর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিচ্ছি। ৭২ থেকে আমি শেখ রাসেলকে পড়ানো শুরু করি। ৭৫ এর ১৪ আগষ্টও আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে রাত ১১টা পর্যন্ত ছিলাম। শেখ রাসেলের গণিতের প্রতি অনীহা ছিল। তবে সে ছাত্র হিসেবে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে মাস্টর বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধুকে শুধু আমি কাছ থেকেই দেখিনি, তাঁর সঙ্গে মধুর ঝগড়ার অভিজ্ঞতাও ছিল আমার। তিনি শিক্ষকদের সম্মান করতেন। কখনো তিনি এলে আমাকে দাঁড়াতে দিতেন না। তিনি বলতেন, তুই শুধু রাসেলের শিক্ষক না, আমারো শিক্ষক।
গৃহ শিক্ষিকা আরো বলেন, শেখ রাসেলকে আমি আদর করে ‘বুচো’ নামে ডাকতাম। এই নামটা সে সাদরে গ্রহণ করেছিল। শেখ রাসেল দেখেছিল আমি মিস্টি খেতে পছন্দ করি না। একদিন সে আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো, ‘কেন আমি মিস্টি খাই না?’ অপছন্দের কথা বলতে সে হাতের পেন্সিল ছুড়ে দিয়ে বললো, আমিও তো পড়তে পছন্দ করি না। তারপর থেকে দুটো মিস্টি প্রতিদিন খেতে হতো। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীকে আমি কাকিমা ডাকতাম। তিনি এতই সাদামাটা ছিলেন আমি কখনো তাঁর বাসায় কোন বিউটিশিয়ানকে দেখিনি। নিজের কাজ নিজে করাকেও তিনি অসম্মানের মনে করতেন না। এমনকি পায়ের স্যান্ডেল ছিড়ে যাওয়াতে সেই স্যান্ডেল মুচির কাছ থেকে সাড়িয়ে আবার পরেছেন। যতদিন ঐ বাড়িতে গিয়েছি, আমার মনে হতো আমি আমার বাড়িতেই আছি। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাই অসম্প্রাদায়িক এবং বন্ধুসুলভ ছিলেন।
মাহবুব জামান বলেন, ডাকসুর নেতৃত্বে থাকার কারণে ‘বঙ্গবন্ধুর’ সান্নিধ্য পাওয়া আমার জন্য সহজ ছিল। তিনি আমাকে ‘ছোট নেতা’ বলে সম্বোধন করতেন। কাছের মানুষদের তিনি বিভিন্ন নামে ডাকতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা ছিল। ১৪ আগষ্ট আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি পরের বছর থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের গোল্ড মেডেল দেয়ার পরিকল্পনা জানিয়েছিলেন। ৭৪ এর বন্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রুটির কারখানায় পরিণত হয়েছিল। আমরা সারাদিন রুটি বানাতাম। রাতে বিমান বাহিনীর সদস্যরা হেলিকপ্টারে করে দুর্গম এলাকায় এই খাবারগুলো পৌঁছে দিতো। বঙ্গবন্ধু এমনভাবে আমাদের দেখভাল করতেন, আমাদের মনে হতো তিনি প্রেসিডেন্ট নন, তিনি একজন স্বেচ্ছাসেবক। দেশের মানুষের প্রতি অসীম দরদ ছিল তাঁর। তিনি আরও বলেন, যখন আমরা ডাকসুর দায়িত্ব নিয়েছিলাম তখন বঙ্গবন্ধু আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, পারবি তো? আমরা আশ্বাস দিয়েছিলেন। তিনি আমাদের উপর ভরসা রেখেছিলেন। অটো পাশের দাবিতে যখন ছাত্ররা মিটিং মিছিল করে উপাচার্যকে কার্যালয়ে আটকে রেখেছিল তখন বঙ্গবন্ধু গণভবন থেকে নিজেই চলে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমন রাষ্ট্রপতি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
মোজাম্মেল বাবু বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘বঙ্গবন্ধু’ হওয়ার পেছনে তাঁর পরিবারেরও অবদান ছিল। বঙ্গবন্ধু পত্নী বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্ত করতে অথবা রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব মামলায় জিততে আইনজীবিদের তিনি নির্দেশনা দিতেন। বঙ্গবন্ধু শুধু রাজনীতি, রাষ্ট্রনায়ক অথবা মহান নেতাই ছিলেন না তিনি একজন অনন্য মানুষ ছিলেন। বাংলাদেশকে সামগ্রিকভাবে বিচার করার ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর ছিল। তাঁর এই গুণে গুণান্বিত হয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু বলতেন, পৃথিবীতে দুই প্রকার মানুষ আছে। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিত এর পক্ষে। আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশও বিশ্বের দরবারে নিজেদের উজ্জ্বল করতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা নিয়েই আমরা এগিয়ে চলছি। যতদিন বাঙ্গালি জাতি থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু আমাদের কাজের অনুপ্রেরণা হিসেবে থাকবেন। আমরা বঙ্গবন্ধুকে স্বশরীরে পাচ্ছি না কিন্তু আমাদের চিন্তা চেতনায় এবং অনুপ্রেরণায় তিনি আছেন এবং থাকবেন।
স্মরণ সভায় বিসিএস সহসভাপতি মো. জাবেদুর রহমান শাহীন, মহাসচিব মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম, যুগ্ম মহাসচিব মো. মুজাহিদ আল বেরুনী সুজন, কোষাধ্যক্ষ মো.কামরুজ্জামান ভূঁইয়া এবং পরিচালক মো. রাশেদ আলী ভূঁঞাসহ অন্যান্য সদস্য, গণমাধ্যম কর্মী এবং দর্শনার্থীরা অনলাইনে যুক্ত ছিলেন। স্মরণ সভাটি বিসিএসের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রচারিত হয়।